Monday, February 22, 2010

দুনিয়া কাঁপানো ৫ মিনিট

প্রাচীন দিনের খাটটি নড়িতেছে। একটি মৃদু অসোয়াস্তিকর শব্দ হইতেছে, ক্যাঁচর ক্যাঁচ ক্যাঁচর ক্যাঁচ।

আকাশমণি কাষ্ঠনির্মিত এই খাটটি গুলবাহার বেগমের পিত্রালয় হইতে আগত, বিবাহের উপঢৌকন হিসাবে। বাসর রাত্রি হইতেই গুলবাহার বেগম এই খাটে সঙ্গম করিতেছে। তাহার সাত বৎসরের বিবাহিত জীবনের প্রায় সকল যৌনক্রিয়াদি এই খাটের উপরেই সম্পন্ন হইয়াছে। কদাচিৎ অন্যত্র যে হয় নাই এমনটি নহে, কিন্তু তাহা ভিন্ন গল্প।

হরকাতুর রহমান প্রবলবেগে নড়িতেছে। গুলবাহার বেগম তাহাকে আলিঙ্গন করে, পুলকাবেশে তাহার চক্ষুদ্বয় নিমীলিত। হরকাতুর রহমান দন্তে দন্তে ঘর্ষণ করিয়া প্রবল উত্তেজনায় মৃদু শীৎকার করিতেছে, গুলবাহার বেগম মনোযোগ দিয়া শ্রবণ করিলো, হরকাতুর অকথ্য সব খিস্তি করিয়া চলিতেছে। সঙ্গমকালে এইরূপ অশ্রাব্য বাণীবর্ষণও ক্রিয়াটিতে নতুন মাত্রাযোগ করিয়া থাকে, তাই গুলবাহার বেগম আপত্তি করিল না। সে তনুমন সঁপিয়া হরকাতুর রহমানকে উপভোগ করিতে লাগিলো।

হরকাতুর শুভ কাজে বেশিক্ষণ টিকিতে পারিল না। অচিরেই সে রূদ্ধকণ্ঠে কাতর শব্দ করিয়া স্খলিত হইল। গুলবাহারের পেটের পেশী প্রকম্পিত হইয়া উঠিল পুলকে।

ঘর্মাক্ত হরকাতুর নিজেকে পৃথক করিয়া হাতের উল্টাপিঠে ললাটের স্বেদ মুছিল, তাহার পর ধপ করিয়া উলঙ্গিনী গুলবাহারের পাশে শুইয়া পড়িল। বলিল, বাপরে!

গুলবাহার পাশ ফিরিয়া একটি হাত রাখিল হরকাতুর রহমানের লোমশ বক্ষে। হরকাতুর আবারও বলিল, বাপ রে বাপ!

গুলবাহার মৃদুকণ্ঠে বলিল, হবে তো?

হরকাতুর রহমান বলিল, হবে না আবার। একটা না, দুটো হবে দেখো!

গুলবাহার এখনও নিঃসন্তান।

হরকাতুর দম লইতে লাগিল। গুলবাহার বলিল, ছেলে হবে না মেয়ে?

হরকাতুর বলিল, তা কী করে বলি? তুমি কী চাও?

গুলবাহার বলিল, ছেলেই ভালো। তাকে ফৌজে পাঠাবো।

হরকাতুর বলিল, আরে ছোহ, ছেলেকে ফৌজে পাঠিও না। পাকিস্তানে বাঙালিদের ফৌজে কোনো আশা নেই।

গুলবাহার বলিল, তাহলে কি জজবারিস্টার বানাবো?

হরকাতুর বলিল, জজ হলে খারাপ না। শুনেছি প্রচুর উপরি কামাই। আর বারিস্টার বানাতে কিন্তু ম্যালা খরচা, হুঁ হুঁ।

গুলবাহার বলিল, তাহলে কী বানাবো?

হরকাতুর কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা করিয়া বলিল, ছেলেকে পত্রিকার সম্পাদক বানিও!

গুলবাহার বলিল, সুবহানাল্লাহ। পত্রিকার সম্পাদক হয়ে দিন রাত কলম পিষবে? মাস গেলে ঘরে চাল বাড়ন্ত?

হরকাতুর মৃদু হাসিয়া কহিল, ওরে মুখ্যু জেনানা, সামনের দুনিয়া চালাবে পত্রিকার সম্পাদকেরা। তারা উঠতে বললে পাকিস্তানী জাতি উঠবে, আর বসতে বললে পাকিস্তানী জাতি বসবে।

গুলবাহার বলিল, গোটা পাকিস্তান?

হরকাতুর হাই তুলিয়া বলিল, পাকিস্তান আর কতদিন টেকে কে জানে? যা দিনকাল পড়েছে, পাঞ্জাবিদের মস্তানি তো আর সহ্য হয় না। তোমার ছেলে বড় হতে হতে পাকিস্তান ভেঙে দু টুকরোও হয়ে যেতে পারে।

গুলবাহার বলিল, আস্তাগফিরুল্লাহ এ আপনি কী বলছেন?

হরকাতুর বলিল, ওরে গরীবের কথা বাসি হলেই ফলে। তবে তুমি চিন্তা কোরো না। তোমার ছেলে মস্ত লোক হবে। দেশের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় বড় কথা লিখবে কাগজে।

গুলবাহার বলিল, বটে?

হরকাতুর বলিল, হাঁ।

গুলবাহার হরকাতুরের বক্ষে মুখ গুঁজিয়া কিছু একটা বলিতে চাহিতেছিলো, এমন সময় বাহিরে একটি ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি শোনা গেলো।

হরকাতুর ঝট করিয়া খাটের উপর উঠিয়া বসিল। বলিল, সর্বনাশ, এখন?

গুলবাহার চাপা কণ্ঠে বলিল, জামাকাপড় পরে পালান জলদি!

হরকাতুর চক্ষের পলকে পায়জামা ও কুর্তা পরিয়া খিড়কির জানালার দিকে ছুটিয়া গেল। গুলবাহার ত্রস্ত হাতে শায়া ঠিকঠাক করিয়া শাড়ি পরিতে লাগিল।

হরকাতুর জানালা দিয়া অদৃশ্য হইবার আগে গুলবাহার বলিল, আপনি যা বললেন, তা-ই যেন হয়!

হরকাতুর হাসিমুখে বলিল, আলহামদুলিল্লাহ। বলিয়া সে সন্তর্পণে জানালা গলিয়া বাহির হইল। আর মনে মনে ভাবিল, ৫ মিনিটের সঙ্গমে কী হাতিঘোড়া উৎপন্ন হয় কে জানে, তবে সে যে দুনিয়া কাঁপাইতে পারিবে না, ইহা আর বিচিত্র কী?

গুলবাহারের সদর দরজায় ঘা পড়িল খটখট করিয়া। তাহার স্বামী আবদুর রহমান ফিরিয়া আসিয়াছেন।

[সমাপ্ত]

1 comment:

শুভ্র said...

সচলে আপনার সবগুলো লেখা পড়লাম। ভালো লাগলো। গেরামিন আর আলুর চ্যাছরামি বন্ধ হোক।