Saturday, October 22, 2011

আদমচরিত ০৪৪


ঊষাকালে নন্দন কানন নিঝুম নিস্তব্ধ থাকে। কাকপক্ষীও তখন নীড়ে কুণ্ডলী পাকাইয়া নিদ্রামগ্ন থাকে। আদম এই সময়েই প্রাতকৃত্য সারিতে গাড়ু হস্তে বাহির হয়। আশেপাশে নন্দন কাননের অপূর্ব সব বৃক্ষ ও ঝোপঝাড়, তারই কোন এক গহীন কন্দরে ঢুকিয়া সে কর্মসাধন করিয়া আসে। বেলা চড়িলে লোকজনের সমাগম বাড়ে, এবং তাহাদের ভিড়ে দুই-চারিটি পরিবেশবাদী সর্বদাই থাকিবে, যাহারা ঝোপেঝাড়ে বাগানক্রিয়া সারিতে দেখিলে হল্লাচিল্লা করে। একবার তো তাহারা পাপারাজ্জিতার সীমাহীন পরাকাষ্ঠা দেখাইতে পত্রিকায় আদমের বমাল চিত্র ছাপাইয়া দিয়াছিল।

আজ ভোরে গাড়ু হাতে বাহির হইয়া আদম বোকা বনিল। বাটীর অদূরেই পৌর চত্বরে বিষম ভিড় দেখা যাইতেছে। কয়েকটি বাদাম ও চটপটিবিক্রেতা স্বর্গদূত সেই ভিড়ের উছিলায় চুটাইয়া ব্যবসা করিতেছে। আদম যোগবলে নিজের বিয়োগবেদনা দমন করিয়া গাড়ুটি পুনরায় অন্দরমহলে রাখিয়া আপেলপত্রটি ঠিকঠাক করিয়া সেই ভিড়ের দিকে আগাইয়া গেল। ঘটনা কী, জানা প্রয়োজন।

কিছু উৎসুক স্বর্গদূতকে কনুইয়ের ঘায়ে পরাভূত করিয়া আদম ভিড় ঠেলিয়া আগাইয়া গেল।

চত্বরের মাঝে দুইটি আসনে আয়েশ করিয়া নির্লিপ্তবদনে বসিয়া আছে আশরাফিল আর আবুলিল। তাহাদের অদূরেই ঘুরঘুর করিতেছে নিউটনিল। জুয়াড়ি সালমানিল ঘুরিয়া ঘুরিয়া ভিড় হইতে পয়সা তুলিতেছে। অদূরে সাপ্তাহিক চান্দের আলোর এক সাংবাদিক হাস্যমুখে উপস্থিত জনতার সাক্ষাৎকার লইতেছে।

আদম ভিড়ের এক কোণায় গিবরিলকে দেখিতে পাইয়া আগাইয়া গেল।

"ওহে গিবরিল, হইতেছে কী এইখানে?" আদম গিবরিলের হস্তধৃত ঠোঙা হইতে একটি বাদাম তুলিয়া দাঁতে কাটিয়া কহিল।

গিবরিল উৎফুল্ল মুখে কহিল, "রেস চলিতেছে, দেখিতেছ না?"

আদম গর্দান ঘুরাইয়া এইপাশ ওইপাশ দেখিয়া কহিল, "কই? কীসের রেস? কে দৌড়াইবে?"

গিবরিল হাসিয়া কহিল, "এ দৌড়ের রেস নহে আদম, ইহা বসিবার রেস।"

আদম ঘাবড়াইয়া কহিল, "এমনও রেস হয় নাকি?"

গিবরিল ইশারায় নিউটনিলকে দেখাইয়া কহিল, "দেখিতেছ ইহাকে? নিউটনিল। দিবারাত্র জ্ঞানবৃক্ষের তলে বসিয়া বসিয়া ঝিমাইত হতভাগা। আচমকা একদিন জ্ঞানবৃক্ষের একটি ফল তাহার মস্তকে আসিয়া আছড়াইয়া পড়িবার পর সে বিপুল আক্কেল লাভ করিয়াছে। গণিত বল বিজ্ঞান বল সব কিছুতেই সে নানা তত্ত্ব ঝাড়িতেছে। অসিতকাষ্ঠ আর খড়ি ছাড়া কোথাও যায় না।"

আদম দেখিল, নিউটনিল একটি অসিতকাষ্ঠে খড়ি দিয়া কী কী হিজিবিজি যেন দাগ কাটিতেছে।

"কী বলিতে চায় সে?" আদম শুধাইল।

গিবরিল বাদামের খোসা ছাড়াইতে ছাড়াইতে কহিল, "নিউটনিল দাবি করিতেছে, সে গতির তিনটি সূত্র আবিষ্কার করিয়াছে। তাহার প্রথমটি হইতেছে, বাহ্যিক বল প্রযুক্ত না হইলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির থাকিবে।"

আদম কহিল, "বটে? তা বাকি দুইটি সূত্র কী?"

গিবরিল কহিল, "বাকি দুইটি সূত্র এখনও ফাঁস করে নাই হতভাগা। কিন্তু প্রথম সূত্র দিয়াই সে বাজার জমাইয়া ফেলিয়াছে। ঐ যে দেখিতেছ সালমানিল? ঐ যে ফাটকা বাজারে ফটকেমো করিয়া বেড়ায়? সে আজ ভোরে আশরাফিল আর আবুলিলকে ধরিয়া আনিয়া রেসের আয়োজন করিয়াছে। বাজির পয়সা তুলিতেছে জনগণের নিকট হইতে, চাহিয়া দেখ।"

আদম দেখিল, লোকজন ঘটিবাটী বেচিয়া পয়সা আনিয়া তুলিয়া দিতেছে সালমানিলের হাতে।

গিবরিল কহিল, "কে সবচে বেশিক্ষণ গদিতে বসিয়া থাকিতে পারিবে, ইহা লইয়া বাজি। কেহ ধরিতেছে আশরাফিলের উপর, কেহ ধরিতেছে আবুলিলের উপর।"

আদম কহিল, "তুমি কাহার উপর ধরিলে?"

গিবরিল কহিল, "এখনও ধরি নাই, বিবেচনা করিতেছি কাহার উপর ধরা যায়।"

আদম কহিল, "আবুলিলের উপরেই ধর। খোদ ঈশ্বর উহাকে ঘাঁটাইতে সাহস পাইতেছেন না, তদুপরি শুনিয়াছি তাহার পশ্চাদ্দেশের ত্বক তক্ষকের ন্যায় সূক্ষ্ম রোমযুক্ত, যাহা ভ্যান ডের ওয়াল বল দ্বারা সংলগ্ন সমতলের অণুপরমাণুর সহিত চিপকাইয়া থাকে। আর নিউটনিল ত বলিতেছেই, বাহ্যিক বল প্রযুক্ত না হইলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির থাকিবে। আবুলিলের উপর বল খাটাইবার মত বলিষ্ঠ বলীবর্দ নন্দন কাননে নাই।"

গিবরিল কিছু কহিল না, আনমনে দূরে সাপ্তাহিক চান্দের আলোর সাংবাদিকের দিকে আঙুল তুলিয়া শুধু হাসিল।

আদম কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিল, "রোসো, গাড়ুখানা কাঁসার দোকানে বেচিয়া কিছু পয়সা লইয়া আসি। আশরাফিলের উপর বাজি ধরিলে লস নাই।"

No comments: