Saturday, August 26, 2006

ইন্দুর দমন কমিশন


(এই গল্পটি প্রাচীন বাংলার পটভূমিতে। অধূনা বাংলার কোন কিছুর সাথে মিল খুঁজে পেলে সেটা আপনার কল্পনাপ্রবণ মনের সমস্যা।)


আলিশান সদাগরী জাহাজ "নোয়ার দোয়া"। চাটগাঁও বন্দরের গর্ব। সদাগর জনগণ শেঠের জাহাজ। কী না যায় ওতে! চাল, ডাল, পানসুপারি, কাপড়, তেল, গ্যাস, জনশক্তি ... কতকিছু! পণ্যের পসরা সাজিয়ে চাটগাঁও থেকে এ জাহাজ নিয়মিত যায় সিংহলের বন্দর ঘুরে সুদূর গুজরাটের শূপর্ারক বন্দরে। সেখানে মাল বেচে ফিরতি যাত্রায় নিয়ে আসে নানারকম ভারতীয় পণ্য, নিরমা সাবান, বোম্বাই নর্তকী, দিলি্লর লাড্ডু, বিএসএফ মার্কা গুলি, টাটা মার্কা চিরুনী, আরব থেকে আসা দুম্বা, আরো কত কী! জনগণ শেঠ লোকটা যেন কেমন। মতিগতি বোঝা দায়। জাহাজের কাপ্তানি ঘনঘন পালটান। একবার একে দেন তো আর একবার ওকে। এ যাত্রায় কাপ্তানি করছে দুর্ধর্ষ মগ কাপ্তান কির্পোলা খান। ঝানু জাহাজী, যদিও মাঝেমাঝেই মাল খেয়ে টাল হয়ে চড়ায় জাহাজ তুলে দ্যায়, ভুল বন্দরে জাহাজ ভিড়িয়ে বসে, জলদস্যু জাহাজ দেখলে জোরসে পাল তুলে ভাগার বদলে নিশান নেড়ে দাওয়াত দেয়। এরও মতিগতি জনগণ শেঠের মতোই, বোঝা ভার। তবে এঁর ওপর জনগণ শেঠের আস্থা আছে, এর আগেও সে কয়েকবার কাপ্তানি করেছে "নোয়ার দোয়া"তে। তবে নিন্দুকেরা বলে একদিন কির্পোলা খান এই জাহাজ আরব সাগরে ডুবিয়ে ছাড়বে।

তো, পাঁজিপুঁথি দেখে, মৌলবি এনে দোয়া পড়িয়ে বন্দর ছেড়েছে নোয়ার দোয়া। জাহাজ বোঝাই মালসামানা, লোকলস্কর। জলদস্যুদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য কামান থেকে শুরু করে কান চুলকানোর জন্য মিহি তুলাপ্যাঁচানো কাঠি, কী নেই জাহাজে! দিনের বেলা সূর্য আর রাতের বেলা চাঁদতারা দেখে জাহাজ চলতে থাকে সিংহলের বন্দরের দিকে। তবে কির্পোলা খানের মেজাজ মর্জি কেমন যেন অদ্ভূত, মাঝে মাঝেই সে ডাইনে বামে জাহাজ মোচড় দিতে বলে। চলতি পথে উদ্ভট ফিরিঙ্গি জাহাজ থেকে প্যাসেঞ্জার তোলে, সামুদ্রিক জেলেদের কাছ থেকে পঁচা অক্টোপাস কেনে দামী তামাকের বিনিময়ে। লোকলস্কররা মৃদু গুঞ্জন তোলে ঠিকই, কিন্তু কির্পোলা খান ওসবে কান দেয় না। সে জাহাজের কাপ্তান, যা খুশি তা-ই করবে, প্রয়োজনবোধে জাহাজ ডুবিয়ে দেবে, লোকজন গুনগুন করতে চায় করুক না!

কিন্তু একদিন দেখা যায়, জাহাজে প্রবল প্রকোপ দেখা দিয়েছে ইন্দুরের। তারা কাঠ কাটে, বস্ত্র কাটে, কাটে সমুদয়। রান্নাঘর থেকে শুরু করে হাগনকোঠি, কোথাও নিস্তার নেই তাদের হাত থেকে। জাহাজের লোকলস্কর কাপ্তানের কাছেই নালিশ ঠোকে, বলে ইন্দুরের বড় যন্ত্রণা।

কির্পোলা খান হাসে। বলে জাহাজে তো ইন্দুর একটুআধটু থাকবেই। এটা তো আর জনগণ শেঠের সাতমহলা মঞ্জিল নয়। নোয়া পর্যন্ত তাঁর নৌকায় এক জোড়া ইন্দুর তুলেছিলেন, আর তাঁর দোয়াতে তো তাদের বংশধরেরা একটু ঘুরে বেড়াবেই। এতো খোঁচ ধরতে নেই। লোকলস্কর প্রতিবাদ করে, বলে, ইন্দুর সব কাটে। কির্পোলা খান হাসে, বলে, ওটাই তো ইন্দুরের কাজ। কাটাকুটি করা। ইন্দুর তো গরু নয় যে দুধ দেবে, হাতি নয় যে কলাগাছ ওপড়াবে।

কিন্তু ইন্দুরের উৎপাত একেবারে অসহনীয় হয়ে পড়ে। উঠতে বসতে ইন্দুর। জাহাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ইন্দুরের দৌরাত্ম্য। সিংহলের বন্দরে ভেড়ার আগে বন্দর কর্তৃপক্ষ একখানা নাও পাঠায় জাহাজে। সেখান থেকে নেমে এক ভিনদেশী কর্তা ফরমান পাঠায়। এ জাহাজে ইন্দুরের প্রবল উৎপাত, একে বন্দরে ভিড়তে দেয়া হবে না। ইন্দুরের উৎপাত সূচকে নোয়ার দোয়া শীর্ষে। এই ইন্দুর না কমালে এই জাহাজকে বন্দর থেকে ভাগিয়ে দেয়া হবে। লোকলস্করের মুখ শুকিয়ে যায়। হায় হায়, বাণিজ্য হবে কিভাবে তাহলে? জনগণ শেঠ কী বলবে? কির্পোলা খান বিরক্ত হয়ে বলে, কী করতে হবে তাহলে? বন্দরকর্তা বলে, ইন্দুর দমনের জন্য ব্যবস্থা নেয়া হোক। কির্পোলা খান মুচকি হাসে, বলে, এ আর এমন কী? ইন্দুর দমন কমিশন বানিয়ে দিচ্ছি, ওরাই ইন্দুরের তেরোটা বাজিয়ে ছাড়বে! তখনকার মতো জাহাজ বন্দরে ভেড়ে, কিছু মাল কেনাবেচা হয়, আর রসদ নিয়ে আবার রওনা দেয় শূর্পারকের দিকে।

লোকলস্কর আবার এসে নালিশ ঠোকে কির্পোলা খানের কাছে, ইন্দুর দমন কমিশন গঠনের পরও ইন্দুরের দুষ্টুমি কমছে না। কির্পোলা খান হাসে মুহুহুহু করে। বলে, আমি তার কী জানি? আমি তো ইন্দুর দমন কমিশন বানিয়েই দিয়েছি, আমার কিসসা খতম এখানেই। তোমরাই গিয়ে শুধাও কমিশনকে, কেন তারা কাজ করে না। লোকলস্কর কমিশনের কার্যালয়ে যায়। জাহাজের খোলে তামাকের গোডাউনের এক কোণায় বসে কমিশনের দুই খুনখুনে বুড়ো কর্মকর্তা, একজন আগে ছিলো খাজাঞ্চি, আরেকজন গোমস্তা। একজনের নাম নিধি সর্দার, আরেকজনের নাম রাম সর্দার। নিধি আর রামের মধ্যে বড়ই কলহ। নিধি যদি ডাইনে যায় রাম যায় বাঁয়ে, তাদের লোকে সারাদিন খুঁজে খুঁজে মরে, নিধি কই, রাম কই, আরে নাই রে নাই রে নাই রে নাই ...। মানে, দু'জনে মিলেমিশে কোন কাজ আজ পর্যন্ত করতে পারেনি।

লোকলস্কর নিধিকে শুধায়, কী ব্যাপার নিধিখুড়ো, ইন্দুর কমে না ক্যান? নিধি বিড়বিড় করে রামকে গাল পাড়ে। বলে ঐ বুইড়া শকুন আমাকে কোন কাজ ঠিকমতো করতে দেয় না। কমিশনের লোকবল সংক্রান্ত দরখাস্ত পাঠাতে হবে কাপ্তানের কাছে, এ নিয়ে রাম জলঘোলা করছে। সব দোষ ঐ রেমোর। লোকলস্কর রামের কাছে যেতেই রাম তেড়ে আসে। বলে, নিধি তো এক পা কবরে দিয়ে রেখেছে, ও কী ইন্দুর দমন করবে? আর মস্তিষ্ক বলে কিছু কি অবশিষ্ট আছে এই বয়সে ... সব তো পাইখানার সাথে দরিয়ায় ঢেলে দিয়েছে। নিধির জন্যই আজ জাহাজে ইন্দুরের এই জয়জয়কার। ইন্দুরেরা কাটাকুটি করে নিধি বসে বসে টপপা ভাঁজে।

এভাবেই কেটে যায় দিন। নিধি আর রামের কোন্দলে কমিশনের কাজ এগোয় না। ওদিকে ইন্দুরেরা গায়ে গতরে ফেঁপে কেঁদো হয়ে উঠতে থাকে। কোঁচা কাটে, পকেট কাটে, কাটে সমুদয়। লোকলস্কর অতিষ্ঠ হয়ে আবার যায় কাপ্তানের কাছে, বলে কমিশন করেও লাভ হচ্ছে না, ইন্দুরের দল একেবারে মনের সুখে দুষ্টুমি করে যাচ্ছে। কির্পোলা খান গোঁপে তা দিয়ে মুচকি হাসে। বলে আচ্ছা ঠিক আছে, আমি একটা অর্গানোগ্রাম করে দিচ্ছি, চিন্তার কিছু নেই, স্বাধীন ইন্দুর দমন কমিশন সব ঠিক করে ফেলবে।

কে এক অর্বাচীন ওদিকে ফিসফিস করে বলে, ইন্দুরের যা গতর হয়েছে, এদের নিকেশ করতে গেলে এখন ঢাল তলোয়ার লাগবে। সেই ঢালতলোয়ার কি নিধি সর্দার আর রাম সর্দারকে দেয়া হয়েছে?

No comments: