Friday, March 24, 2006

নোয়ার গল্প : মেটাফোর নয়, মুখফোড়!


নোয়াকে সবাই জানতো প্রাজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে। সফেদ দাড়ি, মিষ্টি ব্যবহার, সবার জন্যে জাননেসারি, বিশ্বপ্রেমিক নোয়াকে ভালোবাসতো সকলেই। এমনকি মেয়রের কাছে প্রস্তাব গিয়েছিলো, শহরের খালটার নাম নোয়ার নামে করতে। কিন্তু নোয়াখাইল্যা গালি খাবার ভয়ে খালপাড়ের ওয়ার্ড কমিশনার আপত্তি জানিয়েছিলো বলে আর তা করা হয়ে ওঠেনি।

কিন্তু আচমকা এক গরমের দিনে নোয়ার মাথা গেলো বিগড়ে, সে চত্বরে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করতে লাগলো, "পাপ, পাপ, মহাপাপ! নগরবাসী, তোমরা পাপী! ঈশ্বরের সাথে মামদোবাজি করো তোমরা! সময় থাকতে ভালো হয়ে যাও, নইলে কিন্তু পস্তাতে হবে!" এক কুলপিমালাইঅলা সস্নেহে নোয়াকে একটা মালাইকাঠি ধরিয়ে দেয়, সেটা চুষতে চুষতে নোয়া হনহনিয়ে কোথায় চলে যায়।

কিন্তু দুদিন যেতে না যেতে আবার, বাজারের এক কোণে নোয়া হাত আকাশের দিকে তুলে গোল হয়ে দৌড়ায়। "মহাপাপী তোমরা! ধ্বংস হয়ে যাবে সব কিছু। হুঁশিয়ার!" এবার এক শসাওয়ালা নুনমশলা মাখিয়ে একটা শসা ছুলে দেয় নোয়াকে, চপচপিয়ে খেতে খেতে নোয়া চলে যায় কোথায় যেন।

এভাবে মাসভর নোয়ার পাগলামি চলতে থাকে, কখনও তেলেভাজার দোকানের পাশে গিয়ে সে চিৎকার করে, তারপর গরমাগরম গোটা চারেক সিঙ্গারা সান্তবনা পুরস্কার পেয়ে চলে যায় কোথায় যেন; আবার কখনও বিরিয়ানির ম' ম' গন্ধে মাতোয়ারা খাবারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মাতম জুড়ে দেয় সে, মালিক ভালোবেসে একটু কাচ্চি খাইয়ে ঠান্ডা করেন তাকে।

কিন্তু তেপান্তরের মাঠের দক্ষিণ দিকটায় ঠায় দাঁড়ানো ঝাঁকড়া কড়ই গাছটাকে যেদিন শায়িত অবস্থায় পাওয়া যায়, পাশে করাত হাতে নোয়াকেও কাঠি নিয়ে মাপজোক করতে দেখা যায়, লোকজন বোঝে, নোয়ার মাথা ঠিক খিলিয়েপিলিয়ে ঠান্ডা করার নয়, শক্ত প্যাঁদানোর সময় হয়ে এসেছে।

নগরপাল কৈফিয়ৎ চান, বলেন, "নোয়া, বৃক্ষনিধন করলে যে বড়?"

নোয়া বলে, "হুঁ। রেইনট্রি বা কড়ই গাছ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তবে এর কাঠ দিয়ে ভালো জাহাজ তৈরি হয় শুনেছি।"

নগরপাল বলেন, "নোয়া, তোমার যে চীনা আদার আড়ৎ আছে বাজারে, ভুলে গেলে? তোমার কি জাহাজ নিয়ে মাথা ঘামানো মানায়?"

নোয়া বলে, "হুঁ। তোমাদের পাপ সীমা ছাড়িয়েছে। সামনে ভয়াবহ বন্যা। সময় থাকতে নৌকা বানাও।"

নগরপাল দলবল নিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যান।

দিন যায়। নোয়া একটা "সহজ জাহাজ নির্মাণ শিক্ষা" নামের চটি বই দেখে দেখে কড়ই গাছের তক্তা দিয়ে একটা জাহাজ তৈরি করে ফেলে।

একদিন নোয়া আলকাতরা মাখাচ্ছে খোলের গায়ে, নগরের নৌপরিবহন কর্মকর্তা এসে হাজির। সে বলে, "ফিটনেস সার্টিফিকেট বার করো তো নোয়া!'

নোয়া আকাশ থেকে পড়ে। কিন্তু কর্মকর্তা মানতে নারাজ। বলে, সার্টিফিকেট ছাড়া এ জিনিস আমরা ভাসাতে দোবো না। নোয়া বলে, মহাপ্লাবন এলে এ জিনিস আপনা থেকেই ভাসবে। কর্মকর্তা হাসে, বলে, খুব ধূমপান করেছো দেখি!

নোয়া অনেক তর্কাতর্কি করে, কিন্তু লাভ হয় না, নোয়ার জাহাজ কোন ছাড়পত্র পায় না। পরিবেশ কর্মকর্তা বৃক্ষনিধনের দায়ে পরিবেশ ছাড়পত্র দেয় না, নৌপরিবহন কর্মকর্তা লাইসেনস আটকে দেয়, দিনের পর দিন নোয়ার জাহাজ মাঠের কোণায় পড়ে পড়ে রোদবৃষ্টি খায়। আরারাত ক্রীড়া চক্রের ছেলেপুলেরা ফুটবল খেলা শেষে মাঝে মাঝে জাহাজে চড়ে গুলতানি দেয়, নোয়া লাঠি হাতে তেড়ে যায় তাদের দিকে।

মহাপ্লাবন আসে না, নোয়ার জাহাজও ভাসে না, কিন্তু লোকজন দারুণ আমোদ পায় নোয়ার কাজকর্মে, তারা ইঙ্গিত করে শুঁড়িখানায় নোয়ার আনাগোনার দিকে। তার গেলাসে একটু বেশি দারু ঢেলে শুঁড়ি মোটা গলায় হাসে, "এহহে, গেলাসে তো মহাপ্লাবন হয়ে গেলো হে নোয়াদা! উপচে পড়ে গেলো সব! জাহাজ আনবো নাকি?" নোয়া দাঁত কিড়মিড় করে বলে, "পাপ, পাপ, মহাপাপ!"

দিন যায়। নোয়া বিমর্ষ মুখে আদার ব্যবসা করে যায়, তেপান্তরের মাঠে তার জাহাজ রোদে শুকিয়ে শুঁটকি হয়। মহাপ্লাবন আসে না, জাহাজও ভাসে না। কিন্তু লোকমুখে নোয়ার কাহিনী গ্রাম থেকে গ্রাম, গঞ্জ থেকে গঞ্জে, নগর থেকে নগরে ছড়িয়ে পড়ে। আর চীনা ফিসফাসের মতো তাতে রং চড়তে থাকে।

শেষে এক বৃষ্টির বিকেলে গলিতে পানি জমে গিয়ে এক সরাইখানার গল্পবলিয়ে ছোকরার পাৎলুন ভিজে যায় কোমর অব্দি, সে মোমের আলোয় সরাইখানার আধো আধো মাতালদের সামনে পানপাত্তর উঁচু করে বলে, "সুধী মদ্যপের দল, আজ আপনারা শুনবেন নোয়ার মহাপ্লাবনের গল্প!"

কয়েক হাজার বছর পর নোয়ার জাহাজ খুঁজে পায় একদল গবেষক গল্পশিকারী। তেপান্তরের মাঠের ওপর দিয়ে কত ঝড়ঝঞ্ঝা বয়ে গেছে এই কয়েক হাজার বছরে, কড়ই কাঠ শুকিয়ে পাত্থর হয়ে গেছে একেবারে। গবেষকের দল ঠুসঠাস ফটো তোলে, তারপর দেশে ফিরে গিয়ে পত্রিকায় বড় করে প্রবন্ধ লেখে। নোয়ার গল্পে মুগ্ধ মদ্যপদের নেশা কাটে না এই কয়েক হাজার বছরে, তারা খুশিমনে জপ করে যায়।


No comments: