Wednesday, March 01, 2006

সাংসদ সাহেবের মুখ খারাপ


সাংসদ জানেজং জোয়ারদার কিন্তু আগে অমন কটূভাষী ছিলেন না।

ভদ্র পরিবারের সন্তান, বাবা মা লেহাজশিক্ষণে কার্পণ্য করেননি, পড়াশোনাও খানিকদূর করেছিলেন ভালো কলেজেই। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে পড়ে জয়নবমারা-২ আসনে সাংসদ হয়ে আজ তিনি খিস্তি করে বেড়ান।

সেদিনও সংসদে দাঁড়িয়ে এক মহিলা সাংসদকে উদ্দেশ্য করে নানা অশ্রাব্য কটূকাটব্য করেছেন তিনি। বলেছেন, আপনার মতো মাল কতো ছাইজ করলাম, আর আপনি আসেন আমার কাজকামে খোঁচ ধরতে। সবাই গুনগুন করে একটু আপত্তি করেছিলো, কিন্তু সেই মহিলা সাংসদ পালটা গালাগালি করায় থেমে গিয়েছিলো সবাই। সংসদে যখন এসে পড়েছেন, খিস্তি খেউর তো একটু হবেই। এ তো আর বাজার না যে মুখ খারাপ করা যাবে না।

তো, সেদিন বিকেলে এমপি আবাসে বসে বাল্যবন্ধু চান্দুর সাথে বসে কারণ পান করছিলেন জানেজং। চান্দু অত্যন্ত ভদ্র মানুষ, হালকা চোরাচালানির ব্যবসা আছে তার, দোষের মধ্যে একটাই, বিদেশী মদ না খেলে তার পেট আইঢাঁই করে। জানেজং-ও বিদেশী মদের অনুরাগী, দেশী মদ খেলে আজকাল বড্ড অম্লবোধ হয় পেটে, তাই চান্দু প্রায়ই হানা দেয় তাঁর ঘরে। তো, মদ খেতে খেতে বোধ করি একটু বেশিই পান করে ফেলেছিলেন জানেজং, তিনি একসময় টলে পড়ে ঘুমিয়ে যান। ঘুম ভাঙার পর জানেজং আবিষ্কার করেন, তিনি হাসপাতালে। তাঁকে ঘিরে অনেকগুলো উদ্বিগ্ন অচেনা মুখ।

স্টেথোস্কোপ কানে হাসি হাসি মুখে একজন বলে উঠলো. "চমৎকার, জ্ঞান ফিরেছে তাহলে! স্বাগতম জানেজং সাহেব! ২০৫৬ সালে স্বাগতম!"

জানেজং নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখেন, ব্যথা লাগে। একে একে অচেনা মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখেন তিনি, কাউকে চিনতে পারেন না। কিন্তু আস্তে আস্তে সব বুঝিয়ে বলা হয় তাঁকে। মদ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন তিনি, তারপর কোন এক আশ্চর্য প্রভাবে তাঁর আর জ্ঞান ফেরেনি গত পঞ্চাশ বছরে। কৃত্রিম উপায়ে তাঁকে হাসপাতালে পুষ্টি যুগিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিলো। তবে গত কয়েকদিনে তাঁর শরীরে বিপাকের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় ডাক্তাররা আঁচ করেছিলেন যে তিনি বড় মাপের মলত্যাগ করবেন। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি একেবারে জেগেই উঠেছেন। জানেজং সাহেব তাকিয়ে দেখেন, প্যান হাতে এক নার্সের মুখে পরম স্বস্তির হাসি।

কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরে একে এক মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁর দারাপুত্রপরিবার। নাতি নাতনীরাও এখন রীতিমতো মাঝবয়েসী, তারা ছেলেপুলে নিয়ে দেখতে এসেছে প্রাচীন দাদুকে। জানেজং সাহেব আস্তে আস্তে ধকল সামলে ওঠেন, টয়লেটে গিয়ে বড় মাপের সময় কাটিয়ে আসেন, বেরিয়ে এসে কয়েকগ্লাস পানি খেয়ে ফেলেন। তারপর বলেন, "আমি একটু সংসদে যাবো!"

সবাই সাধু সাধু করে ওঠে, কী নিষ্ঠাবান সাংসদ, অসুখের মুখে নিষ্ঠীবন নিক্ষেপ করে তিনি এক চুল সময় নষ্ট না করে ফিরে যেতে চান সংসদে! আহ, পুরনো দিনের মানুষ বলে কথা! যদিও তাঁর আসনটি শূন্য হয়ে সেখানে উপনির্বাচন ও পরবর্তীতে সাধারণ নির্বাচন হয়ে গত পঞ্চাশ বছরে জয়নবমারা-২ আসনে অনেকেই সাংসদ হয়ে সংসদে গিয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে জয়নবমারা-২ আসনটি এখন বারবারাহাতা-১১ আসনে পরিণত হয়েছে, কিন্তু এমন এক অত্যাশ্চর্য ঘটনাকে প্রশ্রয় দিতে আপত্তি করলেন না কেউ। অর্ধশতক আগের এক প্রাচীন প্রবীণ সাংসদ তাঁর প্রজ্ঞাবলে সংসদ আলোকিত করবেন, প্রয়োজনে তাঁর জন্যে নতুন আইন বানানো হবে।

কিন্তু বিধি বাম, সংসদে আধ ঘন্টার মতো কাটিয়ে বিভিন্ন সাংসদের ন্যাকা ন্যাকা ভালোমানুষ গোছের প্রশ্নোত্তর শুনে শুনে জানেজং গেলেন ক্ষেপে। তিনি ফ্লোর পাওয়ার পর মাইক হাতে নিয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, আপনারা কি সাংসদ না অন্য কিছু? আপনাদের কি পুরুষকার নাই? মাগীমানুষের মতো মিনমিন করে এইসব কী বলেন আপনারা? বিরোধীদলের মালখোর বোঁচকামারা ঠগ বাটপারগুলির চোখে আঙুল দিয়ে আমি দেখিয়ে দিতে চাই যে .. .. ইত্যাদি ইত্যাদি।

গোটা সংসদ স্তব্ধ হয়ে যায়, আর তিনি মিনিট পনেরো অনলবর্ষী বকে যান।

তারপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উঠে গম্ভীরভাবে জানান, "মাননীয় সাংসদ, আপনি বোধহয় জানেন না, আজ থেকে প্রায় চলি্লশ বছর আগে সংসদে খিস্তিনিবারণী আইন পাশ করিয়ে আমরা সংসদে যাবতীয় অশালীন কুবাক্য উচ্চারণ বন্ধ করে দিয়েছি। এই আইন অনুযায়ী কেউ সংসদে বাজে কথা বললে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। বিদায়!"

হতভম্ব জানেজং মুখ খোলার আগেই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সাহায্যে তাকে ঘাড়ে ধরে বার করে এনে একটা গাড়িতে চড়ানো হয়।

পঞ্চাশ বছর পর পৃথিবীতে কোন কিছুই আর নষ্ট করা হয় না, তাই সাংসদ জানেজং জোয়ারদারকে একটা বায়োবস্তু বিদু্যৎ কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে ফেলা হয়, প্রত্যন্ত বারবারাহাতা-১১ আসনে লোডশেডিং চলছিলো, বাড়তি বিদ্যুৎ পেয়ে সেখানে এক আঁধার ঘরে আলো জ্বলে ওঠে।


No comments: