Wednesday, February 15, 2006

ছুঁচোকাহিনী


বন্ধুরা, আজ আমি তোমাদের একটা গল্প শোনাতে চাই৷

আমার ছোট্ট ভাগ্নি খুবই আহ্লাদি, কিন্তু উটের মতো গোঁয়ার৷ কোনকিছু পছন্দ না হলে সে উটের মতোই ঘাড়ত্যাড়ামি করে৷ তাকে নিয়ে বড় সমস্যা৷

আজকে আমি উদাস মনে বসে আছি বারান্দায়, সামনের বাড়ির ছাদে চরে বেড়াচ্ছে রূপসী উদ্ভিন্নযৌবনা হরিণীনয়নাতরুণীরা, যদিও অ্যাতো দূর থেকে নয়নফয়ন কিছু দ্যাখার জো নেই, মনে মনে ভাবছি এইবার একখান বাইনোকুলার কিনতেই হবে৷ এক বন্ধু পাখিদেখা ক্লাবে ভেড়াতে চাইছিলো আমাকে, তাকে আমি উল্টে মেয়েদেখা ক্লাবে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি, একটিবার আমাদের বারান্দায় হাজির করিয়ে৷

অবিবাহিত জীবনের এইসব তুশ্চু আনন্দভোগে এসে বাগড়া দিলো আমার ভাগি্ন৷ ঘন্টাদুয়েক ধরে অনেক সাধ্য সাধনা শেষে খাওয়াপর্ব শেষ হয়েছে তার, এখন একটি ঘুম হলেই আজকের সন্ধ্যেটা পার করে দেয়া যাবে৷ কিন্তু ঘুমের আগে তার গল্প দরকার৷ আমার বোন তাকে হাজারোবিজারো গল্প এর মধ্যে শুনিয়েছে, প্রচলিত সব রূপকথার স্টক ফুরিয়েছে, শিশুসাহিত্যের সব রাজপুত্র আর রাজকন্যা, সব বাঘ আর বক, সব শেয়াল আর কুমীর তার চেনা হয়ে গেছে৷ ভুল করে কোন পুরনো গল্প শুরু করে দিলে সে ভারি বিরক্ত হয়৷ বলে, 'ও, এটা সেই শেয়ালটা যেটা ভেড়ার বাবুটাকে খেয়ে ফেলেছিলো?' অথবা, 'হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই বাঘটাই তো শেষে রাজপুত্রের ঢিশুম খেয়ে মরলো!' কাজেই রোজ তাকে নূতন গল্প শোনাতে হয়৷

আজ আমার বোন তাকে লেলিয়ে দিয়েছে আমার পেছনে৷ 'যাও, ঐ যে ছোটমামা বারান্দায় বসে মাছি মারছে, মামার কাছে গিয়ে গল্প শুনে এসো৷'

যেহেতু আমার ভাগি্নকে গল্প শোনাতে হয় তার মুখের দিকে তাকিয়ে, কাজেই মেয়েদেখাকার্যক্রমে আমাকে ইতি টানতেই হলো৷ বললাম, 'কি মামণি, চাচাকাহিনী শুনবে?'

সে রাজি হয় না৷

'তাহলে তোতাকাহিনী?'

তাও তার জানা৷

অতএব আমাকে নিজের রুগ্ন কল্পনাশক্তির আশ্রয় নিতে হয়৷ 'ছুঁচোকাহিনী?'

ভাগি্নর মুখে খুশির রোদ ওঠে৷ 'হ্যাঁ হ্যাঁ, ছুঁচোকাহিনী! ছুঁচোকাহিনী!'

আমি শুরু করি, 'এক দেশে ছিলো এক রাণী .. ..৷'

অমনি সে থামিয়ে দেয়, 'ছুঁচো কী?'

আমাকে বোঝাতে হয় ছুঁচো কী চিজ৷ তারপর আবার গল্প শুরু করতে হয় গোড়া থেকে৷ দু'পা এগোতে না এগোতেই সে আবার প্রশ্ন করে৷ আমি উত্তর দিই৷ তারপর আবার গল্প শুরু হয়৷ আবার সে প্রশ্ন করে৷ আমি উত্তর দিই৷ এভাবে হাজারখানেক প্রশ্নোত্তরের পর যখন গল্প ফুরোয়, তখন সে আমার কোলে বসে ঘুমিয়ে কাদা৷ বাইরে অন্ধকার, আমার চোখের খোরাক সেই চকিতহরিণপ্রেক্ষণা বিম্বাধরোষ্ঠীর দল হাওয়া৷

কিন্তু গল্পটা তোমাদের না শুনিয়ে ছাড়বো না৷ আর কেউ যদি গল্পের মাঝখানে ট্যাঁ ফোঁ করেছো তো এক চড়ে বত্রিশখানা দাঁত .. ..৷



এক দেশে ছিলো এক রাণী৷

প্রশ্ন উঠতে পারে, রাজা কোথায়? রাজা কি বনবাসে না মৃগয়ায়? নাকি পাশের রাজ্যের রাণীর হাত ধরে ভাগলো? কত কিছুই ঘটতে পারে, রটতে পারে, এই রাজাগজাদের কাজকামের কোন আগামাথা নাই৷ কিন্তু এই রাণীর রাজা আর বেঁচে নেই৷ সেনাপতির সাথে কুস্তি লড়তে গিয়ে তাঁর মর্মান্তিক মৃতু্য হয়েছে৷ তাঁর মৃতু্যর পর সেনাপতি গলা খাঁকরে বললেন, 'দেখুন, ওনাকে আছাড়টা আমি ওভাবে দিতে চাই নি, কিন্তু কুস্তির জোশে দিয়ে ফেলেছি৷ .. .. তো, এখন উনি যখন এন্তেকাল করলেন, রাণী তো রাজ্যশাসনের কিছুই বোঝেন না, রাজপুত্রেরা নাবালক, কাজেই আমার মনে হয় আমি রাজা হলেই রাজ্যের মঙ্গল৷' প্রজার দল ভারি নিরীহ, তারা রাজা আর সেনাপতির মধ্যে তফাত্‍ করতে পারে না, কারণ এই রাজাও আগের রাজাকে হটিয়ে সেনাপতি থেকে রাজা বনে গিয়েছিলেন৷ তারা ভাবলো, এটাই বুঝি রাজতন্ত্রের দস্তুর, তারা কিছু বললো না৷

সেই সেনাপতি রাজা চুটিয়ে রাজ্যশাসনের নামে যা তা করে বেড়াতে লাগলেন৷ প্রায় বছর দশেক এমনটা করার পর লোকজন ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে তাঁকে একদিন পেঁদিয়ে সিংহাসনচু্যত করে সেই রাণীকেই আবার টেনে আনলো৷ বললো, 'আপনিই রাজ্যের ভার নিন৷'

তারপর নদীর জল অনেক গড়িয়েছে, এই রাণীর হাত থেকে আবার ক্ষমতা গিয়েছে আর এক রাজকন্যার হাতে, আবার তাকে হটিয়ে রাণী ক্ষমতায় এসেছেন৷ রাজ্যের অবস্থা এখন কিছুটা অস্থির৷ চুরিডাকাতি, খুনখারাবি বেড়ে গেছে, জিনিসপত্রের দাম চড়া, সবাই অতিষ্ঠ৷

গোল বেঁধেছে রাণীর এক মন্ত্রীকে নিয়ে৷ ইনি হচ্ছেন রাস্তামন্ত্রী৷ এককালে তিনি মানুষকে কুবুদ্ধি বিক্রি করতেন, সেই কুবুদ্ধি খাটিয়ে তিনি এখন দেশের মন্ত্রী৷

রাস্তামন্ত্রী, নাম তাঁর মজনুল দুহা, কিছুদিন আগে শোরগোল তুলেছিলেন, তিনি রাজ্যে পক্ষীরাজ সার্ভিস চালু করবেন৷ ছোট রাজপুত্রের সাথে এ ব্যাপারে তার কীসব গোপন আলাপও নাকি হয়েছিলো৷ পক্ষীরাজ এই রাজ্যের মানুষ জীবনে কখনো চামড়ার চোখে দেখেনি, শুধু পুঁথিতে পড়ে এসেছে, শুনেছে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারের দেশে নাকি পক্ষীরাজ ওড়ে৷ কিন্তু সেখান থেকে এই গরীব রাজ্যে পক্ষীরাজ আমদানি করতে গেলে সবার ঘটিবাটি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে, সেকথা কি মজনুল দুহা বোঝেন না? মজনুল দুহা বড় বড় চৌরাস্তায় ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে ঘোষণা করেন, 'হে প্রজাগণ, শিগগীরই আপনারা পক্ষীরাজে চড়ে শহর থেকে বন্দরে যেতে পারবেন, সময় লাগবে মোটে এক ঘটিকা৷ আর আপনাদের মহামান্য কনিষ্ঠ যুবরাজ আপনাদের জন্যে এই পক্ষীরাজ আমদানির ব্যবস্থা করবেন৷ ঘাবড়াবেন না ভাইসব, নানা জনে নানা কথা বলে এই পক্ষীরাজ নিয়ে৷ কিন্তু আমি বেঁচে থাকলে এই পক্ষীরাজ আমদানি কেউ ঠেকাতে পারবে না!'

প্রজাদের মধ্যে যারা অভিজ্ঞ, যারা সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারের দেশে গিয়েছিলো, তারা খুব ঘাবড়ে গিয়ে বলে, 'সে কি! এই পক্ষীরাজ তো খুবই খরুচে জিনিস হে! তার এক বেলার খোরাকের দাম সহস্র নিযুত মুদ্রা! সেই টাকায় দেশে কয়েকশো বিদ্যালয় খোলা যায়! তাছাড়া, আমাদের নিয়মিত অশ্বগুলোই তো নানা রোগে ভুগছে, সেগুলোর চিকিত্‍সা না করিয়ে রাস্তামন্ত্রী পক্ষীরাজের পেছনে মাতলেন কেন? এ তো গরীবের ঘোড়া রোগ হে!'

সবাই ভাবে, পক্ষীরাজের প্রতি মজনুল দুহার এই পক্ষপাতিত্ব কেন৷ ভেবে ভেবে সবার মাথা গরম হয়, কিন্তু কেউ কোন কিনারা পায় না৷ .. .. সবাই যখন এই আলোচনায় মত্ত, তখন একদিন মজনুল দুহা এক প্রলয়ঙ্কর কান্ড ঘটিয়ে ফেলেন৷ তার আগে ছোট্ট এক ইতিহাস বলে নিই৷

অনেক অনেক আগে এই রাজ্যে একবার খুব ছুঁচোর উপদ্রব হয়েছিলো৷ প্রায় এক পুরুষ ধরে দূর রাজ্যের ছুঁচোরা এই রাজ্যে এসে প্রবল উত্‍পাত করেছিলো৷ তারা এই রাজ্যের সব শস্য লুটেপুটে নিয়ে সেই দূররাজ্যে জমা করতো৷ এই রাজ্যের মানুষ একদিন আর সহ্য করতে না পেরে ঠিক করলো, ছুঁচোদের এই বদমায়েশি বন্ধ করতে হবে৷ ভাবতে না ভাবতে সেই বিদেশি ছুঁচোরাইে রাজ্য একেবারে আক্রমণ করে বসলো৷ তাদের আক্রমণে অনেক নিরীহ প্রজা মারা পড়লো, অনেক শস্য নষ্ট হলো, ক্ষেতের পর ক্ষেত উজাড় করে বসলো তারা৷ আর তাদের সাথে যোগ দিলো দেশি কিছু ছুঁচো৷ দেশিবিদেশি গন্ধমূষিকদের অত্যাচারে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়লো৷ প্রায় নয়মাস সময় লেগেছিলো সেই ছুঁচোদের তাড়াতে৷

যখন বিদেশি ছুঁচোগুলো হটে গেলো, তখন দেশি ছুঁচোরাও আর বেশি উত্‍পাত করার সাহস পেলো না৷ লোকজন আবার হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো৷ ছুঁচোর আক্রমণে রাজ্য ছারখার হয়ে গিয়েছিলো, সবাই আবার নতুন করে চাষবাসে মন দিলো৷ কিন্তু কয়েক বছর পর আবার গন্ডগোল শুরু হলো৷ ছুঁচোর কামড়ে কিছু পেয়াদা পাগল হয়ে গিয়েছিলো, তারা এক রাতে করলো কি, দল বেঁধে রাজ্যের রাজা-রাণী-রাজপুত্র সবাইকে মেরে শেষ করে ছাড়লো৷ তারা বললো, এখন রাজা হবে আমাদের সেনাপতি৷

দেখা গেলো, নতুন রাজা খুব ছুঁচোভক্ত৷ তিনি ছুঁচো পোষা শুরু করলেন৷ তার এই ছুঁচোপ্রীতির খবর রটে যাওয়ার পর যেসব ছুঁচো বনের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে লুকিয়ে ছিলো, তারা বেরিয়ে আসতে লাগলো৷ যেসব ছুঁচো পালিয়ে গিয়েছিলো, তারাও ফিরে এলো৷ প্রজারা দেখলো, লক্ষণ খুব একটা সুবিধের নয়৷ রাজা নিজেই যখন এমন ছুঁচোপাগল, তখন ছুঁচোদের গায়ে টোকা দিলেও তিনি ক্ষেপে উঠবেন৷ সুযোগ পেয়ে ছুঁচোরাও আস্তে আস্তে দল পাকাতে লাগলো, তাদের উত্‍পাত আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো৷
এখন অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে, রানীর দরবারে ছুঁচোরাও বসে এখন৷ দুটো গোবদা বুড়ো ছুঁচো রানীর পায়ের কাছে চোখ লাল করে বসে থাকে, আর নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কি কি সব যেন বলে৷ শেয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দেয়ার একটা প্রবাদ প্রচলিত ছিলো সে রাজ্যে, কিন্তু লোকজন তা-ও ভুলে গেলো যখন রানী একটা ছুঁচোকে শস্যমন্ত্রী বানিয়ে দিলেন৷ একটা ছুঁচো যদি শস্য সামলায়, তবে সমাজ কোথায় যাবে? উত্তর সহজ, আরেকটা ছুঁচোর কাছে৷ মানে, আরেকটা ছুঁচোকে রানী সমাজমন্ত্রী বানিয়ে দিয়েছেন৷

ওদিকে সারা রাজ্যে ছুঁচো আর ছুঁচোর ছানারা উত্‍পাত করে বেড়াচ্ছে৷ তারা দল বেঁধে একে কামড়ায়, তাকে কাটে৷ প্রজারা নিরীহ মানুষ, এই বিষাক্ত ছুঁচোদের বিরূদ্ধে কিছু করতেও সাহস পায় না৷

তো, এই ছুঁচোর ছানারা একদিন একটা ভোজসভা ডেকেছে৷ সেই সভায় তারা অতিথি করে এনেছে সেই আলোচিত রাস্তামন্ত্রী মজনুল দুহাকে৷ কেন, কে জানে৷ বোধহয় তাদের রাস্তা এই মন্ত্রীর কল্যাণে পরিষ্কার হচ্ছে, সেই সুবাদে৷

তো, অতিথি হলে, খেয়েদেয়ে একটু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাটাই সেই রাজ্যের রীতি৷ মজনুল দুহা পেট পুরে সেই ছুঁচোদের খাদ্য খেলেন, তাঁর মুখে কিভাবে রুচলো, কে জানে৷ খেয়েদেয়ে অন্যান্য ছুঁচোদের সাথে একযোগে ঢেঁকুর তুলে তিনি বক্তৃতা শুরু করলেন৷

'প্রাণের প্রাণ, দিল কি টুকরা ছুঁচোরা আমার! আজকে তোমাদের ভোজে অংশগ্রহণ করতে পেরে আমি আনন্দিত৷ তোমরা যে আমাকে বন্ধু বলে ভাবো, এতেও আমি আনন্দিত৷ তোমরা হয়তো জেনে আনন্দিত হবে যে আমিও তোমাদের বন্ধু বলে ভাবি ্ল.. ..৷'

ছুঁচোরা খুব করতালি দিতে লাগলো, আর কিচকিচ করে বলতে লাগলো, 'মারহাবা, মারহাবা, বহোত খুব৷' ছুঁচোদের ভাষায় এর মানে হচ্ছে, 'বাহবা, বেশ হচ্ছে, চালিয়ে যান!'

এমনি চালিয়ে যাচ্ছিলেন রাস্তামন্ত্রী মজনুল দুহা৷ চলতে চলতে হঠাত্‍ কি যেন ঘটে গেরো, তাঁর রসনা-ঘোড়ার লাগাম গেলো ফসকে৷ তিনি বলতে লাগলেন, 'প্রিয় ছুঁচোরা! রাজতন্ত্র-মন্ত্রতন্ত্র-যন্ত্রতন্ত্র এসব কিচ্ছু বুঝি না! আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে একটাই, ছুঁচোতন্ত্র! এ দেশে ছুঁচোতন্ত্র কায়েম করতে হবে! অতীতেও এ দেশে ছুঁচোতন্ত্র কায়েমের প্রচেষ্টা হয়েছে৷ দেশবিদেশের ছুঁচো ভাইয়েরা নিজেদের তন্ত্র কায়েমের জন্যে শস্য লুটপাট করেছে, প্রজাদের কামড়ে শেষ করেছে৷ কিন্তু তারা তো শুধু নিজেদের তন্ত্রের অখন্ডতা বজায়ের জন্যেই এসব করেছে৷ এটা তো কোন অপরাধ নয়! ছুঁচোদের এই মহান কীর্তিকে এ রাজ্যের কিছু প্রজা অপব্যাখ্যা করে বেড়াচ্ছে .. ..৷' ইত্যাদি৷
কয়েকজন প্রজা ছুঁচোদের সভায় মজনুল দুহার এই বক্তৃতা শুনে ফেললো৷ শুনে আবার অন্যদেরকে জানিয়েও দিলো৷


রাজ্যশুদ্ধ প্রজা শুনে ভারি ঘাবড়ে গেলো৷ এ কী কথা বললেন রাস্তামন্ত্রী? অ্যাঁ? শেষটায় কি ছুঁচোর কামড়ে পাগল হয়ে গেলেন নাকি? এ পাগলামির কারণেই কি তিনি পক্ষীরাজ নিয়ে অমন চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছিলেন? রাজতন্ত্র ফেলে রাজ্যে ছুঁচোতন্ত্র কায়েম করতে হবে? এ কি কোন সুস্থ মানুষের কথা? আর ছুঁচোরা কোন অপরাধ করেনি? রাজ্যটাকে লুটে শেষ করে দিয়েছিলো যেই ভয়ঙ্কর ছুঁচোবাহিনী, তিরিশ লক্ষ প্রজাকে কামড়ে খুন করেছে যে ছুঁচোরা, এখনও যেসব ছুঁচো এ রাজ্যের প্রজাদের কামড়ে চলেছে প্রতিদিন, তারা কোন অপরাধ করেনি? এটা একটা কথা? তাহলে অপরাধ কারা করেছিলো? কাদের দোষ ছিলো?
এ নিয়ে খুব তোলপাড় চলতে লাগলো রাজ্যে৷ রাণীর কানেও কথাটা গেলো, কিন্তু অবাক কান্ড, তিনি কিছু বললেন না৷

রাজদরবারের ছুঁচোদুটো মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো কেবল৷ রাজদরবারে ভেতরে চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগলো তারা৷ সেখানে আরো কয়েকটা ছুঁচো ঘোরাঘুরি করছে মন্ত্রী হবার আশায়৷
সব প্রজাই যখন নানা জল্পনা কল্পনা করছে এসব নিয়ে, তখন এক চারণ কবি এসে খবর দিলো, খবর শুনেছো নাকি ভাইসব?

সবাই বললো, না তো, কী হয়েছে?

চারণ কবি বললো, আমাদের রাস্তামন্ত্রী মজনুল দুহার অবস্থা যে শেষে পিনোকিয়োর মতো হয়েছে গো!

সবাই বললো, পিনোকিয়ো? কে সে? কী হয়েছিলো তার? মাথা কাটা পড়েছিলো নাকি?

চারণ কবি চোখ কপালে তুলে বললো, সে কী কথা? পিনোকিয়োর নাম শোননি? সেই যে রূপকথার গল্পের নায়ক, মিছে কথা বলায় যার নাক লম্বা হয়ে গিয়েছিলো? মনে পড়ে?

সবাই বললো, ও হ্যাঁ, তাই তো, তাই তো৷

চারণ কবি বললো, সেদিন ছুঁচোদের ভোজে এক গাদা মিছে কথা বলেছিলো রাস্তামন্ত্রী৷ তাই স্রষ্টা তাকে শাস্তি দিয়েছেন, ঠিক পিনোকিয়োর মত৷

সবাই সোত্‍সাহে বললো, অ্যাঁ, তাই নাকি? নাক লম্বা হয়ে গেছে ব্যাটার?

চারণ কবি মাথা দুলিয়ে বললো, শুধু নাকই লম্বা হয়নি, পেছনে একটা ল্যাজও গজিয়েছে৷ এখন তার লম্বা নাক, নাদা পেট আর বাহারী লেজ৷ সব মিলিয়ে তাকে দেখাচ্ছে কিসের মতো, বলো তো?

এক হাবা বললো, হাতির মতো?

চারণ কবি বললো, মোটেও না৷

এক বুদ্ধু বললো, গন্ডারের মতো?

চারণ কবি বললো, একদম না৷

এক পাগল বললো, দাঁড়াও দাঁড়াও, আমি বলছি৷ ছুঁচোর মতো!

চারণ কবি তার দোতরায় পিড়িঙ পিড়িঙ শব্দ তুলে বললো, ঠিক৷ ঠিক৷

প্রজাদের বেশ মনে ধরলো কথাটা৷ তারা চারণ কবির গানে সুর মেলালো, আহা বেশ বেশ বেশ৷


ব্যস, আমার গল্প ফুরোলো, আমার ভাগ্নি ঘুমোলো৷

আর তোমরা তো খবরের কাগজ রোজই পড়ো, তোমাদের আর এ গল্প শুনিয়ে কী লাভ?


No comments: