Monday, February 13, 2006

জুতা নিরপেক্ষতা


অফিসে জুতা নিয়ে গন্ডগোল শুরু করেছেন ওহাব সাহেব।

অনেকে বলে গন্ডগোলটা শুরু করেছেন হানিফ সাহেব। কে গন্ডগোল শুরু করেছেন এ নিয়েও একটা গন্ডগোল হয় মাঝে মাঝে।

ওহাব সাহেব ফাটা কোম্পানীর কালো চামড়ার আট নাম্বার জুতা পরেন। জুতায় ফিতার জন্য দশটা ফুটা আছে। এ নিয়ে তাঁর গর্বের অন্ত নাই। খেতে বসে তিনি স্ত্রীকে মাঝে মাঝে বলেন, "বুঝলা গুলজারের মা, ফাটা কোম্পানীর ৮ নাম্বার কালা জুতা হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জুতা। এতে কোন সন্দেহ নাই। যারা সন্দেহ করে, তাদের জন্য আমার করুণা হয়। হাসি পায়।"

ওহাব সাহেবের স্ত্রী কিছু বলেন না। ফাটা কোম্পানীর ৮ নাম্বার কালো জুতা তাঁর পরার কোন প্রশ্নই আসে না, তিনি পরেন স্যান্ডেল। তাই এর গুণাগুণ সম্পর্কেও তাঁর কোন বক্তব্য নাই।

ওহাব সাহেব পুত্র গুলজারকেও ফাটা কোম্পানীর ৮ নাম্বার কালো জুতা কিনে দিয়েছেন। তারা দুইজন সকালে একই সাথে বাসা থেকে বের হন, একই রকম জুতা পরে। দেখে ওহাব সাহেবের বেশ আনন্দ হয়। কী সুন্দর দৃশ্য। বাপবেটার পায়ে একই কোম্পানীর একই রকম জুতা। ফাটা কোম্পানীর ৮ নাম্বার কালা জুতা। আহা।

হানিফ সাহেব ওহাব সাহেবের দীর্ঘদিনের সহকর্মী, তিনি আবার পরেন বোম্বাই কোম্পানীর ৪১ নাম্বার বাদামী জুতা। বোম্বাই কোম্পানীর জুতার মাপ একটু অন্যরকম, ফুটাও দশটার জায়গায় বারোটা। কালা জুতা হানিফ সাহেব পছন্দ করেন না, তিনি বাদামী জুতার ভক্ত। তাঁর পুত্র দিলদারও বাদামী জুতা পরে, ৪১ নাম্বার, সেই বোম্বাই কোম্পানীর। জুতা পায়ে দিয়ে মাঝে মাঝে হানিফ সাহেব তৃপ্ত শ্বাস ফেলেন, আহা, কী জুতা বানাইলো বোম্বাই কোম্পানী! তাঁর পায়ে সেই জুতার স্বাদ অমৃতের মতো মনে হয়।

একদিন মুখ ফসকে এটাই বলে ফেলেছিলেন হানিফ সাহেব, "আহা!" ওহাব সাহেব পাশের টেবিলেই ছিলেন, তিনি সহাস্যে মুখ তুলে বলেন, "কী মিয়া, আহাউহু করো ক্যান?"

হানিফ সাহেব দুপুরবেলা অফিসে জুতা খুলে টেবিলে পা তুলে বসে কাজ করেন, জুতাটা তাঁর পা থেকে খুললেও আরাম লাগে, আবার পরলেও আরাম লাগে। তিনি বললেন, "বোম্বাই কোম্পানীর ৪১ নাম্বার বাদামী জুতা, বুঝলা ওহাব, এরা জিনিসও বানাইছে একখান!"

ওহাব সাহেব মুখটাকে জুতার মতোই কালো করে ফেলেন, বলেন, "হানিফ, জুতা শুধু পায়ে দেয়ার জিনিসই না। জুতার মর্যাদা বুঝার চেষ্টা করো। জুতা মানুষের মান সম্মানের প্রতীক। একে পারলে মাথায় তুলে রাখতাম, খোদার ইশারায় পায়ে দিয়া চলতেছি। শুইনা রাখো, দুনিয়াতে জুতা একটাই আছে ভদ্রলোকের, ফাটা কোম্পানীর ৮ নাম্বার কালা জুতা!"

হানিফ সাহেব হেসে ওঠেন। "কী যে বলো ওহাব। বোম্বাই কোম্পানীর ৪১ নাম্বার বাদামী জুতা পায়ে দিয়া দ্যাখো মিয়া, কী আরাম। জুতা তো জুতা না, জাম্বুরার শরবত!"

ওহাব সাহেব নাক সিঁটকান। "দ্যাখো, ঐসব ফালতু জুতা পায়ে দিয়া তোমার মাথাটা গরম হইছে। ফাটা কোম্পানীর ৮ নাম্বার কালা জুতা পর মিয়া। আমার বড় শালার ক্যানসার ভালো হইয়া গ্যালো এই জুতা পায়ে দিয়া!"

হানিফ সাহেব একটু অপমানিত হন শালা তুলে কথা বলায়। "কী যে কও ওহাব। জুতা হইলো বোম্বাই কোম্পানীর ৪১ নম্বর বাদামী জুতা, বাকি সব জুতা নিকৃষ্ট, কমজাত!'

ওহাব সাহেব তপ্ত হয়ে ওঠেন। "ফাটা কোম্পানীর ৮ নাম্বার কালা জুতা যাদের পায়ে দেয়ার যোগ্যতা নাই, তাদের মুখে জুতা নিয়া বড় বড় কথা মানায় না!"

এভাবে তর্ক প্রবলতর হতে থাকে। হানিফ সাহেব কটাক্ষ করে বলেন, ওহাব সাহেবের পূর্বপুরুষ তো খড়ম পায়ে হাঁটতো, জুতার মর্ম তিনি কিভাবে বুঝবেন?

ওহাব সাহেব ফুঁসে উঠে বলেন, হানিফ সাহেবের পূর্বপুরুষ তো মনিবের ফাটা কোম্পানীর ৮ নাম্বার কালা জুতা বগলে নিয়ে হাঁটতো, পায়ে কী দিতে হয় তিনি কিভাবে বুঝবেন?

এক পর্যায়ে প্রবল তর্কাতর্কি, একে অন্যের দিকে ফাইল ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু হলো। আরেক সহকর্মী কুদ্দুস সাহেব এসে বহুকষ্টে দুইজনকে শান্ত করলেন।

"এই বয়সে কী শুরু করলেন আপনারা?" কুদ্দুস সাহেব বিরক্ত হয়ে বলেন।

হানিফ সাহেব আর ওহাব সাহেব দুজনেই একসাথে গর্জাতে থাকেন, কুদ্দুস সাহেব তাঁদের ধমকে থামান।

বড় সাহেব হাউকাউ শুনে সবাইকে তলব করেন। ওহাব সাহেব আর হানিফ সাহেব তড়বড়িয়ে গিয়ে একজন আরেকজনের নামে অভিযোগ করেন, গন্ডগোলে কিছুই বোঝা যায় না। বড় সাহেব বিরক্ত হয়ে কুদ্দুস সাহেবকে বলেন, "কী হয়েছে বলেন দেখি?"

কুদ্দুস সাহেব কিছু বলার জন্য মুখ খোলেন, কিন্তু ওহাব সাহেব তাঁকে থামিয়ে দ্যান। "সাক্ষী দেয়ার আগে বলেন, আপনি নিজে কোন জুতা পায়ে দ্যান, ফাটা কোম্পানীর আট নাম্বার কালা জুতা, নাকি বোম্বাই কোম্পানীর ৪১ নাম্বার বাদামী জুতা?"

হানিফ সাহেবও প্রশ্ন রাখেন, "হ্যাঁ বলেন! আপনি নিজে কোন জুতা পায়ে দ্যান, বোম্বাই কোম্পানীর ৪১ নাম্বার বাদামী জুতা নাকি ফাটা কোম্পানীর ৮ নাম্বার কালা জুতা?"

কুদ্দুস সাহেব বিরক্ত হয়ে বলেন, "সেইটা নিয়ে কথা উঠছে ক্যান? আমি তো জুতানিরপেক্ষ মানুষ, আমি যে-ই জুতাই পায়ে দেই, আপনাদের কাজিয়া নিয়ে তো আর মিথ্যা কথা বলবো না!"

ওহাব সাহেব ঠা ঠা করে হাসেন। "জুতানিরপেক্ষ মানুষ? মানে আপনি ফাটা কোম্পানীর ৮ নাম্বার কালা জুতাও পরেন, আবার বোম্বাই কোম্পানীর ৪১ নাম্বার বাদামী জুতাও পরেন? ছোহ, কী চরিত্রহীন আপনি!"

হানিফ সাহেবও জুতানিরপেক্ষতার প্রবল নিন্দা করেন।

কুদ্দুস সাহেব বোঝানোর চেষ্টা করেন, জুতানিরপেক্ষতা মানে ফাটা কোম্পানীর ৮ নাম্বার কালা জুতা আর বোম্বাই কোম্পানীর ৪১ নাম্বার বাদামী জুতা দুটাই পায়ে দেয়া নয়, বরং কে কী জুতা পায়ে দিয়ে ঘোরে সেটা নিয়ে মাথা না ঘামানো। জুতা দিয়ে মানুষ বিচারের বিরোধী তিনি।

ওহাব সাহেব তীব্র আপত্তি তোলেন, কুদ্দুস সাহেবের মতো তথাকথিত জুতানিরপেক্ষর সাক্ষ্য তিনি গ্রহণযোগ্য নয় বলে দাবী করেন। হানিফ সাহেবও সায় দ্যান। বড় সাহেব কিছু বুঝতে না পেরে সবাইকে বিদায় হতে বলেন।

ওহাব সাহেব ফিরে গিয়ে ঘোষণা করেন, হানিফের মতো নিম্নমানের জুতাপরা লোকের পাশে বসে তিনি কাজ করবেন না। অফিসে যারা বোম্বাই কোম্পানীর ৮ নাম্বার কালা জুতা পরেন, তাদের পাশে বসে কাজ করবেন, সে পিয়ন হোক আর বড় সাহেব।

হানিফ সাহেবও জানিয়ে দেন, যারা বোম্বাই কোম্পানীর ৪১ নাম্বার বাদামী জুতা পরার মর্ম বোঝে, তাদের পাশে বসেই তিনি কাজ করবেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিসে একটা ভাগবাঁটোয়ারা হয়ে যায়, এক পক্ষে ফাটা কোম্পানীর ৮ নাম্বার কালা জুতা, অন্য দিকে বোম্বাই কোম্পানীর ৪১ নাম্বার বাদামী জুতা।

কিছু লোক অবশ্য সমস্যায় পড়ে। যেমন আলমগীর সাহেব ফাটা কোম্পানীর ৮ নাম্বার বাদামী জুতা পড়েন, তিনি কী করবেন বুঝতে পারেন না। মোস্তফা সাহেব পড়েন বোম্বাই কোম্পানীর ৫১ নাম্বার কালা জুতা, তিনিও সমস্যায় পড়েন। এরকম আরো কয়েকজন আছেন, যাঁরা কোম্পানী মিললেও সাইজ মেলাতে পারেন না, সাইজ মেলাতে পারলে রঙ মেলাতে পারেন না, আবার রঙ মেলালে কোম্পানী মেলাতে পারেন না। তবে এরকম কিছু এলোমেলো সংখ্যালঘুদের নিয়ে ওহাব সাহেব আর হানিফ সাহেব মাথা ঘামান না, তাঁরা দল ভারি করে দুইজন দুই কোণায় পড়ে থাকেন।

অফিসে হয়তো শান্তি ফিরে আসতো, কিন্তু পরদিন ওহাব সাহেব তাঁর নতুন প্রতিবেশী জগলুল সাহেবের সাথে জুতা প্রসঙ্গে আলাপ করতে করতে আবারও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। জগলুল সাহেব প্রথমে শান্তই ছিলেন, পরে তিনিও ক্ষেপে ওঠেন। জগলুল সাহেবের পায়ে ফাটা কোম্পানীর ৭ নাম্বার কালা জুতা। তবে আজকে ওহাব সাহেব তেমন একটা হইচই করেন না, শুধু জগলুল সাহেবের টেবিলে পড়ে থাকা নতুন স্ট্যাপলারটা নিজের জিম্মায় নিয়ে আসেন। ওদিকে হানিফ সাহেবও জনৈক অভাগা ইয়াকুবের পায়ে বোম্বাই কোম্পানীর ৪১ নাম্বার বাদামী জুতায় আটটা ফুটা খুঁজে পেয়ে ক্ষেপে ওঠেন। ভালো জুতায় ফুটা থাকে বারোটা, আটটা ফুটা নিয়ে জুতা পরার শখ কেন? বেচারা ইয়াকুবের নতুন বলপয়েন্ট পেনটা তিনি আনমনে নিজের পকেটে গোঁজেন।

এমনিভাবেই রোজ রোজ চলতে থাকে। জুতানিরপেক্ষ কুদ্দুস সাহেব এবং আরো কয়েকজন বোঝানোর চেষ্টা করেন সবাইকে, কিন্তু লাভ হয় না। জুতানিরপেক্ষতা আবার কী? এইসব আজেবাজে কথা শুনতে কেউ রাজি নয়।

বড় সাহেব অফিসের এইসব গন্ডগোলে ভারি অসহায় বোধ করেন। কী বলবেন এঁদের, কী বোঝাবেন? বোঝাতে গেলে এরা সবাই মিলে তাঁর ওপর চড়াও হবে, কারণ তিনি জুতাই পড়েন না। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়িতে চড়ে অফিসে আসেন, পাতলা একজোড়া চপপল পড়ে থাকেন সবসময়।

No comments: