Sunday, September 03, 2006

রহস্যগল্প ০০৭

গাব্রিয়েল মগাদিশু চৌরাসিয়ার দিনকাল খারাপ যাচ্ছে। এরকম রহস্যজর্জরিত একটা পাড়ায় বাস করেও কেস জুটছে না তাঁর হাতে। জুটছে না বললে ভুল হবে, কেস রোজই জোটে এক গাদা, কিন্তু পয়সা দিতে চায় না কেউ।

পরামর্শটা দিয়েছে প্রতিবেশী ও পানের সঙ্গী পমি রহমান।

"খোকাপুরুষের কাছে যান।" পমি রহমান ভোগান্তি খায় না, তার পছন্দ বিয়ার, তারই বোতলে এক চুমুক দিয়ে বলে সে।

"খোকাপুরুষ?" মগাদিশু চৌরাসিয়া একটি ভুরু উত্তোলিত করে তাকান পমি রহমানের দিকে।

"হুম। মরমী জ্যোতিষী। হাত দেখে ভূত ভবিষ্যৎ বলে দেয়।" পমি রহমান জানায়। "শুধু হাত দেখলে একটা সংশয় ছিলো, কিন্তু এই ব্যাটা একেবারে ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস কষে বলে দেয় সব। শুনেছি," গলা নামিয়ে বলে সে, "কী একটা ফাইয়ের নামতা নাকি আছে, ঐ নামতা পড়ে সব নাকি গুনে বলে দেয়া যায়!"

"বলেন কী?" চৌরাসিয়া নড়েচড়ে বসেন।

"আর বলি কী? সৃষ্টিজগত সব ঐ ফাইয়ের দড়ি দিয়ে আঁটা। বজ্র আঁটুনি। তবে গেরোটা ফস্কা। খোকাপুরুষ ঐ গেরোতে আঙুল দিয়ে বসে আছেন। যখন খুশি গেরো খুলে সব দেখেটেখে ফেলেন।"

"আপনি কিভাবে জানেন এতকিছু?" চৌরাসিয়া একটু আবছা তদন্তে লিপ্ত হন।

"ঐ মানে, মিসেস অর্ধকুমারীর সাথে আবার উনার অনেক জানপেহচান। ওর সাথেই একবার ঐ ব্যাটার আড্ডায় গিয়েছিলাম। হাতটা দেখাতে। দুইজনের একসাথে কোন সম্ভাবনা আছে কি না ... হে হে হে .. বুঝতেই পারছেন।" পমি রহমান হাসে। "উনি তো আমাদের দুজনের অনেক কথা হাত দেখে বলে দিলেন! আমি তো তাজ্জুব!"

"বটে?" চৌরাসিয়া ভোগান্তিতে চুমুক দেন।

"হাঁ! আপনিও যান। উনি পাথর টাথরও দিয়ে থাকেন শুনেছি। আমাকে দিতে চেয়েছিলেন। বললেন, টেক দিস জেম, ডুড। ইট রকস, ডুড। আমি বললাম, নাহ থাক, পাথর কেনার পয়সা নাই, প্রেমভালোবাসা হলে এমনি হবে, পাথর দিয়ে কী লাভ?" পমি রহমান উদাস দৃষ্টিতে বাম হাতের মধ্যমায় পড়া একটা পাথুরে আংটি দেখে, আর দেখায়।

"এই সেই পাথর? কিনলেন শেষ পর্যন্ত?" চৌরাসিয়া জানতে চান।

"আমি কিনি নাই।" পমি রহমান বলে। "অর্ধকুমারীই উপহার দিলো।"

"হুমম।" চৌরাসিয়া বলেন।

"যা বলছিলাম, যান আপনি ব্যাটার কাছে। এই পাথর ধারণ করার পর থেকেই বেশ ইয়ে বোধ করছি ... বুঝলেন তো। এই তো গতকাল ক্যাবে চড়ে ঘুরলাম দুইজন ... কলা খেলাম, বাদাম খেলাম ... আপনিও সব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবেন।"

চৌরাসিয়া একটু গম্ভীর হয়ে যান। মিসেস অর্ধকুমারী তাঁর রেগুলার ক্লায়েন্ট। অনেক টাকা বাকি রেখেছে মহিলা। সেগুলি শোধ না করে পমি রহমানকে পাথর কিনে দেয়াটা যেন তিনি বরদাশত করতে পারেন না।

তবুও পমি রহমানের পীড়াপিড়িতে তিনি আজ এসেছেন খোকাপুরুষের কাছে। সাদাসিধা চেহারা খোকাপুরুষের, বড়বড় চুলদাড়িগেরুয়ার বালাই নাই। পরনে সাদা গেঞ্জি আর লাল লুঙ্গি। গেঞ্জিতে লেখা, লেটস গেট সুফি, বেবি!

চৌরাসিয়ার হাতটা একটা মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে কী যেন দেখেন খোকাপুরুষ আনমনে। তারপর একটা প্যাডে কী সব নোট করেন। একটা ভার্নিয়ার ক্যালিপার্স নিয়ে অনেক মাপজোকও নেন বিভিন্ন রেখার। তারপর টিভি ছেড়ে ডিসকভারি চ্যানেল ধরেন। সেখানে মহাকাশ নিয়ে একটা প্রোগ্রাম দেখেন মিনিট পাঁচেক। তারপর বের করে আনেন এক প্রাচীন পুঁথি। সেখানে হরেক রকম ছক কাটা। খোকাপুরুষ অঙ্ক করতে থাকেন সেসব ছক দেখে। সব দেখে শুনে খোকাপুরুষ হাত পাতেন, দক্ষিণা পাঁচটি হাজার টাকা তাঁকে দিতে হবে আগে, আর বার্থ সার্টিফিকেট। চৌরাসিয়া গম্ভীরমুখে পাঁচহাজার টাকা ভর্তি একটা খাম ধরিয়ে দেন তার হাতে। খোকাপুরুষ খাম ছিঁড়ে নোট বার করে বৃদ্ধাঙ্গুলিতে লালা লাগিয়ে গোনেন। পাঁচশো, একশো, পঞ্চাশ, বিশ, দশ আর দুই টাকার নোটে পাঁচ হাজার টাকা হয় ঠিক ঠিক। বার্থ সার্টিফিকেটটাও মনোযোগ দিয়ে দেখেন মাইক্রোস্কোপের নিচে ফেলে।

চৌরাসিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসেন তিনি। "বলুন, কী জানতে চান?"

চৌরাসিয়া গম্ভীর গলায় বলেন, "আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু বলুন।"

খোকাপুরুষ হাসেন। ঠান্ডা, মরমী হাসি। বলেন, "ভবিষ্যৎ তো ভালো না। অর্থকষ্টে ভুগবেন। আপনার হাতের ধনরেখার কার্ভেচার আর জন্মতারিখে পাঁচের কুপ্রভাব সেটাই সাজেস্ট করে। একেবারে পঞ্চত্ব পেয়ে বসেছেন। সামনের পাঁচটা মাস খারাপ যাবে। লোকজন জ্বালাতন করবে, পাঁচজনে এসে পাঁচটা কথা শুনিয়ে যাবে। পাঁচড়াও হতে পারে গায়ে, স্বাস্থ্যরেখার স্লোপ অন্তত তাই বলছে। প্রেমরেখার সেকেন্ড ডেরাইভেটিভ দেখে মনে হচ্ছে, আপনার স্ত্রীর সাথে সামনে কিচাইন হবে অনেক।"

চৌরাসিয়া ক্ষেপে ওঠেন একদম। ব্যাটা ভাঁড়, এইসব পেঁচো কথাবার্তা শুনিয়ে পাঁচ পাঁচটি হাজার টাকা খসিয়ে নেবার ধান্ধা?

খোকাপুরুষ বকে যান। "আপনি চাইলে পাথর ধারণ করে দেখতে পারেন। আপনার জন্য বৈদুর্য্যমণি সু্যট করবে।" চৌরাসিয়া মন্দ্রস্বরে বলেন, "এ-ই দেখতে পেলেন ঐ মাইক্রোস্কোপে?"

খোকাপুরুষ হাসেন। "মাইক্রো নয়, ওটা ন্যানোস্কোপ। আমার কাজ ন্যানোকসমিক পর্যায়ে।"

"আর ঐ পুঁথি দেখে অঙ্ক কষলেন যে?" চৌরাসিয়া আঙুল তুলে দেখান।

"ওটা পারস্যের বিখ্যাত সুফি জ্যোতিষী মহাজনেজাদের নিজের হাতে লেখা পান্ডুলিপি। আপনি নিশ্চয়ই গোল্ডেন রেশিও ফাই সম্পর্কে অবগত আছেন ... মহাজনেজাদ এই ফাই নিয়ে অনেক ফরমায়েশ করেছেন তাঁর লেখায় ...।"

চৌরাসিয়া বলেন, "আর আমার হাতের রেখার যে মাপজোক করলেন?"

খোকাপুরুষ হাসেন। "হুঁ। গ্রহনক্ষত্রের ছক ফেলে দেখলাম। রবি নীচস্থ, শুক্র অপ্রকৃতিস্থ, বৃহস্পতি বহুদিন যাবৎ তুঙ্গে নেই, শনির দশায় আচ্ছন্ন আপনি, চন্দ্র ভেগেছে, রাহুতে কেতুতে একেবারে লদকালদকি কান্ড, আর মঙ্গল লিপ্ত বুধের সাথে বিবাদে। আর কী চান?"

চৌরাসিয়া গম্ভীর হাসেন। "আপনি কি ডিসকভারিতে দ্যাখেননি, সৌরজগত পাল্টে গেছে? তিন তিনটা নতুন গ্রহ ঢুকে পড়েছে? কই, আপনি তো ইউরেনা, নেপচুন আর প্লুটো নিয়ে কিছু বলতে পারলেন না, নবাগতা সেরেস, শ্যারন আর জেনাকে সামলাবেন কিভাবে?"

খোকাপুরুষ খিলখিল করে হাসেন। "ওহ, এই সামান্য ব্যাপারে আপনার আপত্তি?"

চৌরাসিয়া বলেন, "মোটেও সামান্য নয়। বলুন ঐ ছয়টা গ্রহ আপনার ছকে নেই কেন?"

খোকাপুরুষ বলেন, "এটা তো খুব ইজি ব্যাপার, মান! নো বিগ ডিল মান! আপনিই বলুন, অন্ধকার মোষতাক, এবি বেবি ছায়েম, কিংবা ক্ষতিপুর রহমান আমাদের দেশের রাজনীতিতে কী এমন প্রভাব ফেলেছেন? কেউ উনাদের নাম বলে? সবাই তো বড় বড় নেতাদের নিয়েই অস্থির! বড়রা যেখানে রকিং, হোয়াই শুড দিস টিনি উইনি বেবিজ বি টকিং? হিসাব ভেরি সিম্পল, মান!"

চৌরাসিয়া রীতিমতো ক্ষেপে ওঠেন। "বটে? আমি এর প্রতিবাদ করবো। নাসার কাছে আমি চিঠি লিখবো। আপনাদের মতো ড্যাম চীট লায়ারদের ঢীঢ করে ছাড়বো!"

খোকাপুরুষ চোখ টিপে হাসেন। "আরে নাসা থেকে আমার কাছে চিঠি এসেছে! ওরাই আমাকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যেতে চায়! আমি ওদের কাছে একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম, প্রোজেক্ট চামিস্ট্রি নাম দিয়ে। হাত দেখার সুযোগে বোকা পাবলিককে কসমোলজি শেখাবো। ভেরি নাইস প্রোগ্রাম, নাসাই ফান্ড যোগাবে বলেছে!"

চৌরাসিয়া থ হয়ে যান! খোকাপুরুষ হাসেন। "আর ওরা কিছু চাঁদের পাথরও দেবে আমাকে বলেছে। ভালো দামে বিক্রি হবে।" চোখ টেপেন তিনি।

চৌরাসিয়া দন্তকিড়মিড় করে বলেন, "আপনি একটা আপাদমস্তক দুই নাম্বার ধান্ধাবাজ!"

খোকাপুরুষ খিলখিল করে হাসেন। "ট্রু, মান, ট্রু! চান্দাবাজি তো করছি না, ধান্ধাবাজিই সম্বল! যাই হোক, আমার এখন ইন্টারনেটে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে, নাসায় মরমী জ্যোতিষবাদ নিয়ে একটা পেপার পড়তে হবে কি না ... সেটা গোছানো জরুরি ... আজকে তাহলে আসুন! কৃতজ্ঞতা!" উঠে ভেতরের ঘরে চলে যান তিনি।

চৌরাসিয়া দেখেন, খোকাপুরুষের গেঞ্জির পেছনে লেখা, সেল গড চীপ, বেবি!

চৌরাসিয়া রাগে গরগর করতে করতে বেরিয়ে আসেন। পমি রহমানটাকে হাতের কাছে পেলে কিলিয়ে কাঁঠালপাকা করতে হবে!


১৮ আগস্ট, ২০০৬।

No comments: