Monday, September 04, 2006

রহস্যগল্প ০০৩


গাব্রিয়েল মগাদিশু চৌরাসিয়া ধড়ফড় করে উঠে বসেন বিছানায়। তারপর তাকান ঘরোয়া ঘড়ির রেডিয়ামচর্চিত কাঁটার দিকে। রাত দেড়টা। দুঃস্বপ্ন দেখে যে তাঁর ঘুম ভাঙে না, এমন নয়। মাঝে মাঝেই স্বপ্নে দেখেন বউটা বাপের বাড়ি থেকে গাঁটরি বোঁচকা সহ ফেরত এসেছে, এসেই শাড়ি গাছকোমর করে পেঁচিয়ে তাঁকে কান পাকড়ে ধমকাচ্ছে, "বাসাবাড়ির এই হাল? য়্যাঁ?"

তবে আজ দুঃস্বপ্ন নয়। ঘুম ভেঙেছে দরজায় করাঘাতের শব্দে। না, তাঁর দুঃস্বপ্ন সত্যি হয়ে ওঠেনি, বউটা এলে দরজায় লাথি মারে। সম্ভবত কোন প্রতিবেশী, খুচরা কোন রহস্য নিয়ে এসেছে। রহস্যের সমাধান হয়ে গেলে শালারা ঠিকমতো টাকাপয়সাও দেয় না, দিচ্ছি-দেবো করে খালি ঘোরায়। দীর্ঘসূত্রিতা। মাঝে মাঝে ভাবেন চৌরাসিয়া, ফেনসিডিলের ব্যবসায় নেমে পড়বেন। এই রহস্যভেদীর ব্যবসা আর পোষায় না।

লুঙ্গিটা সুচারুরূপে গিট্টুবন্দী করে চৌরাসিয়া গটগটিয়ে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটা জোরালো হুঙ্কার দেন, "কে র‌্যা?"

একটি কম্পিত কণ্ঠ ভেসে আসে দরজার ওপাশ থেকে, "আমি!"

চৌরাসিয়া ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবেন, তারপর বলেন, "আমি কে?"

এবার যেন কম্পন একটু কমে আসে, "আপনি গাব্রিয়েল মগাদিশু চৌরাসিয়া!"

হুমম, ভাবেন চৌরাসিয়া, নিঃসন্দেহে এটা মোড়ের লাল বাড়ির ভাড়াটিয়া বারমুডা খান। এরকম পাঁঠা কোটিতে গুটিক মেলে। দরজা খুলতেই তিনি তাঁর ডিডাকশনের মাহাত্ম্য টের পান। বারমুডা খান কাঁপতে কাঁপতে বলে, "চুরি, চুরি হয়েছে চৌরাসিয়া ভাই! একেবারে ল্যাংটা করে রেখে গেছে আমাকে!"

চৌরাসিয়া চেয়ে দ্যাখেন, আসলেই, বারমুডা খান খবরের কাগজ পরে চলে এসেছে। ঊর্ধ্বাঙ্গে একটা খাটো গামছা। চৌরাসিয়া বিরক্ত হয়ে বলেন, "চুরি হয়েছে তো পুলিশে খবর দিন, আমি কী করবো?"

বারমুডা খান কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, "পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ হয়রানি করে। মারে।"

চৌরাসিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, "চলেন দেখি কী অবস্থা।"

চৌরাসিয়া অকুস্থলে পৌঁছে দেখেন, আসলেই রহস্যজনক চুরি হয়েছে। মূল্যবান কিছু চুরি যায়নি, শুধু বারমুডা খানের পরিধেয় যাবতীয় জিনিস ঝেড়ে দিয়েছে কে বা কাহারা। একেবারে ল্যাংটা করে রেখে গেছে তাকে। বারমুডা খান সুবোধ সুশীল, সে দশটার মধ্যেই খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো, হঠাৎ শীত শীত লাগায় ঘুম ভেঙে উঠে দেখে সে দিগম্বর, তার আলনায় একটা সুতাও নেই, শুধু বারান্দায় তার এই গামছা আর টেবিলের ওপর বাসি খবরের কাগজ সম্বল করে সে তৎক্ষণাৎ চৌরাসিয়ার শরণাপন্ন হয়েছে।

চৌরাসিয়া ভুরু কুঁচকে বলেন, "আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?"

বারমুডা খানের চোখ জ্বলে ওঠে। সে বলে, "প্রচন্ড ঘৃণায় ঠিকমতো বুঝিয়ে বলতে পারছি না, তবে আমার তো সন্দেহ বাড়িওয়ালাকেই। আমাকে বাড়ি থেকে খ্যাদানোর একটা ... একটা অপচেষ্টা এইটা।"

চৌরাসিয়া বলেন, "তাই নাকি? বাড়িওয়ালার সাথে বিবাদ আছে নাকি আপনার? খুলে বলুন!"

বারমুডা খান খুলে বলে, কোমরে খবরের কাগজ ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে। বাড়িওয়ালা লোকটা ভালো না, তার একটা বেকার গুন্ডা ভাগিনা আর বদমাশ কাজের লোক আছে, এই তিনজনের একজন অনায়াসে নকল চাবি দিয়ে রাতের বেলা ঘরে ঢুকে বারমুডা খানের আলনা থেকে যাবতীয় কাপড় এবং মেঝে থেকে তার পরনের লুঙ্গিটি গাপ করে নিয়ে চলে যেতে পারে।

চৌরাসিয়া ঘরের ভেতর চারদিক খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে থাকেন ক্লু এর জন্যে। উঁহু, ঘর একেবারে পরিষ্কার। এবার বাহিরের দরজার কাছে যেতে না যেতেই এক বিরাট ক্লু পেয়ে যান তিনি। সদ্য চুনকাম করা দেয়ালে এক বিশাল ছাপ। হাতের নয়, পায়ের নয়, পিঠের!

চৌরাসিয়া মৃদু মৃদু হাসেন। বারমুডা খান তেড়েফুঁড়ে ওঠে, "দ্যাখেন কতবড় বদমাইশ, মাত্র চুনকাম করিয়েছি নিজের পয়সায়, হেলান দিয়ে নষ্ট করে দিয়ে গেছে!"

চৌরাসিয়া বলেন, "বাড়িওয়ালার কাজের লোকের কীর্তি এটা। জিনিসপত্র নিয়ে ভাগার সময় অসাবধানে ছাপ রেখে গেছে।"

বারমুডা খান অবাক হয়ে বলে, "কিভাবে বুঝলেন?"

চৌরাসিয়া হাসেন। "সহজ। বাড়িওয়ালা উচ্চবিত্ত মানুষ, তার বেকার ভাগিনাটা মধ্যবিত্ত, আর কাজের ছোকরা নিম্নবিত্ত। আমাদের সমাজে উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্তের পিঠ কখনো দেয়ালে ঠ্যাকে না, ঠেকলে ঠ্যাকে নিম্নবিত্তের। কাজেই কাজের ছোকরারই কাজ এটা। কাল সকালে ওকে পাকড়ে দুটা চড় মারলেই জামাকাপড় ফেরত দিয়ে যাবে। ... আমার ফি কালকে সন্ধ্যেবেলা পৌঁছে দিয়ে যাবেন, আর হ্যাঁ, ট্যাবলয়েড পত্রিকা পড়া ছেড়ে ভালো কোন দৈনিক পড়ুন, জ্ঞানও বাড়বে, বিপদের সময় আরো ভালো কাজেও দেবে ... গুড নাইট!"


০৬ জুলাই, ২০০৬

No comments: