Sunday, September 03, 2006

রহস্যগল্প ০০৫


গাব্রিয়েল মগাদিশু চৌরাসিয়া একটা সাদাকালো হাফপ্যান্ট পরে নিজের বৈঠকখানায় পায়চারি করছেন। সাদাকালো হাফপ্যান্ট মানে এই নয়, এর একটা পায়া সাদা, অন্যটা কালো। সাদাকালো প্যান্ট মানে এ-ও নয় যে প্যান্টটা জেব্রার মতো ডোরা বা পোলকা ফুটকি দিয়ে ছোপানো। প্রকৃতপক্ষে প্যান্টটা সাদাই ছিলো, এখন ময়লা হয়ে কালচে মেরে গেছে। বউ ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে গেছে, তাই চৌরাসিয়া অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে ঘরে ময়লা জামা পরে থাকতে পারেন।

পায়চারি করতে করতেই মগাদিশু চৌরাসিয়া প্যান্টের পকেট থেকে ভোগান্তির বোতল বার করেন। তাঁর পকেটগুলি বোতলের মাপে তৈরি করা, তিনি মর্জিমাফিক কোনদিন ৭০০ মিলি কোনদিন ৩৩০ মিলির হাফপ্যান্ট পরেন। পায়চারি করতে করতেই তিনি বোতলে রহস্যভেদীসুলভ একটি গুরু চুমুক দিয়ে সোফায় উপবিষ্ট মিসেস অর্ধকুমারীর দিকে দৃষ্টিপাত করেন। "আপনি বলতে চাইছেন, কে বা কাহারা গত রাতে আপনার ফ্ল্যাটের দরজাটাকে একেবারে আগাপাস্তলা লাল রং করে দিয়ে গেছে?"

মিসেস অর্ধকুমারী শুষ্কমুখে সায় দেন। আজ তিনি মাথায় সাদাকালো (ডোরাকাটা) একটা হিজাব পরে এসেছেন। "তো দিলোই না হয়। আপনার সমস্যা কোথায়?" মিসেস অর্ধকুমারী চটে ওঠেন। বলেন, "কী যে বিশ্রী একটা কটকটে রং, না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না! তাছাড়া আমার দেয়ালের সাথে ঐ রংটা ম্যাচ করে না মোটেও! তাছাড়া ... তাছাড়া গায়ে পড়ে এভাবে দরজা রং করে দেয়াই বা বরদাশত করবো কেন? আজকে দরজা রং করছে কালকে ঘরে ঢুকে ছুরি মারবে! আপনি এর একটা বিহিত করে দিন!"

চৌরাসিয়া গম্ভীর মুখে আবার পায়চারি শুরু করেন। গত পরশু থেকে শুরু হয়েছে এই ফ্যাকড়া। অর্ধকুমারীকে নিয়ে মোট হলো চারজন। সবারই একই অভিযোগ। কে বা কাহারা এসে ঘরের দরজায় রং করে দিয়ে যায়। মক্কেলগুলো মহা ব্যাক্কেল। ঘরের দরজায় রং করে যায় কে বা কাহারা, কিন্তু তারা ঠাহর করতে পারে না। এটার জন্য তাদের রহস্যভেদীর শরণাপন্ন হতে হয়। এটা একটা কথা হলো? আর বিহিত করে দিলেও তো শালারা পয়সা দিবে না! গত পরশু এসেছিলো বারমুডা খান। তার আগের রাতে কে নাকি তার ঘরের দরজা একেবারে কাঁঠালপাতারঙা করে দিয়ে গেছে। না, এবার বাড়িওয়ালাকে সন্দেহ করছে না সে। বাড়িওয়ালা এমনই কঞ্জুষ মাক্ষিচুস যে পান খেয়ে দরজায় পিক পর্যন্ত ফেলবে না, রং করে দেয়া তো দূরের কথা। তার ধারণা, এটা কোন রূপক হুমকি, কোন মাফিয়াবাহিনীর শাসানি। চৌরাসিয়া সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়ে তাকে বিদায় করেছেন। গতকাল সকালে এসেছিলেন পাশের ফ্ল্যাটের মিস মঞ্জুময়ূরী। তাঁরও একই অভিযোগ। তবে তাঁর ঘরের দরজার রং হলুদ করে দেয়া হয়েছে, গত রাতে। মঞ্জুময়ূরীর সন্দেহ সিনে সাংবাদিক পমি রহমানকে, কারণ হলুদ সাংবাদিকতা করে করে নাকি ঐ ব্যাটার হলুদের ওপরই একটা ইয়ে জন্মে গেছে। কেন পমি রহমান গায়ে পড়ে তাঁর ঘরের দরজা রং করে দেবে, এ প্রশ্নের সদুত্তর মঞ্জময়ূরী দিতে পারবেন না, এবং দিতে পারবেন না বলেই তো মগাদিশু চৌরাসিয়ার কাছে আসা। তবে তিনি আর এই ফ্ল্যাটে আপাতত একা একা থাকতে সাহস পাচ্ছেন না, উত্তরায় বড় বোনের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন, চৌরাসিয়া যাতে এই রহস্যের একটা কিনারা করেন। চৌরাসিয়া পমি রহমানকে পাকড়াও করে সন্ধ্যেবেলা জেরা করবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু বিকেলে সে নিজেই এসে হাজির। অভিযোগ, কে বা কাহারা সকাল থেকে বিকেলের মধ্যে তার ঘরের দরজায় বিদঘুটে একটা নীল রং করে দিয়ে গেছে, মুরগির ঘরের দরজাতেও নাকি কেউ ওরকম বিশ্রী রং লাগায় না। পমি রহমানের সন্দেহ মিস মঞ্জুময়ূরীর দিকে, মহিলার নাকি মতলব ভালো নয়, কিন্তু তাঁর পক্ষে যে ঐ কাজ করা সম্ভব নয় তার সাক্ষী আবার স্বয়ং চৌরাসিয়া, উত্তরায় বোনের বাসায় চলে যাবার অ্যালিবাই আছে মহিলার। পমি রহমান ফোঁসফোঁস করতে থাকে হলুদ রঙের বৃত্তান্ত শুনে। চৌরাসিয়া তাকেও বিদায় করেন সাবধানে থাকতে বলে। আর আজ মিসেস অর্ধকুমারী এসেছেন লাল রঙের নালিশ নিয়ে। হুমমমমমমমমম।

মিসেস অর্ধকুমারীকে বিদায় করে দিয়ে চৌরাসিয়া মিনিট দশেক ভোগান্তি পান করেন। মদ্যপান করলে তাঁর বুদ্ধি আরো ধারালো হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে তিনি ঘরে তালা মেরে বের হন। চিন্তামগ্ন ছিলেন বলে ঐ ময়লা হাফপ্যান্টটা পরেই বেরিয়ে পড়েন। হাঁটতে হাটতে এসে হাজির হন মোড়ের রাস্তার রঙের দোকানে। দোকানের নাম আগে ছিলো উজ্জ্বল রং বিতান, এখন সেটার নাম পালটে রাখা হয়েছে রং দে বাসন্তী । দোকানী লাল মিয়াকে শুধান চৌরাসিয়া, "সবুজ, তোমার দোকানে গত তিন দিনের মধ্যে কি কার্বন মাঝি সাহেব কোন কেনাকাটা করেছেন?" সবুজ লাল মিয়ার ডাকনাম। লাল মিয়া তাম্বুলরঞ্জিত দংষ্ট্রারাজি বার করে হাসে। বলে, "আরে উনি তো গত তিন দিন ধইরাই খালি রং, থিনার আর ব্রাশ কিনতে আছেন!

চৌরাসিয়া গম্ভীর হাসেন। "বটে? কী কী রং কিনেছেন?"

লাল মিয়া খানিকক্ষণ খাতা ঘেঁটে বলে, "সবুজ, হলুদ, নীল, লাল আর কালা।"

চৌরাসিয়ার খটকা লাগে, তিনি বলেন, "কালো? কালো রঙও কিনেছে নাকি?"

লাল মিয়া মাথা ঝাঁকায়। "হ।"

চৌরাসিয়া মুষড়ে পড়েন। লাল মিয়ার দোকানে দাঁড়িয়েই কয়েক চুমুক ভোগান্তি পান করেন। তারপর শ্লথ পায়ে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করেন। কেন যেন তাঁর মন বলছে, বাড়ি ফিরে দেখবেন তাঁর ঘরের সুন্দর বাদামী বার্ণিশ করা দরজাটাকে কে বা কাহারা একেবারে কালো রং দিয়ে পোঁচ মেরে একাকার করে রেখেছে ...!

-----------------------------------------

১০ জুলাই, ২০০৬

No comments: