Friday, February 10, 2006

আমাদের পাড়ায় ফুটবলের ভবিষ্যৎ


মফস্বলের পোলাপান আমরা৷ কম্পিউটার নাই ফুটবল খেলি সত্যিকার মাঠে৷ ইন্টারনেট নাই, ব্লগ লিখতে পারি না৷

কিন্তু যার মাঠে ফুটবল খেলি, সেই রহমান চাচা বড় চামার৷ বিনা কারণে দোতলার বারান্দায় এসে খ্যাচখ্যাচ করে৷ "ঐ পোলাপান, ল্যাখাপড়া নাই তোমাগো? দিনরাত খালি বল পিটাও? বাপমায় জানে যে ল্যাখাপড়া ফালায়া বল পিটাও? খাড়াও, দিতাছি বিচার!"

এইসব খ্যাচখ্যাচ আমরা আমল দেই না, কিন্তু মাঝে মাঝেই আমাদের বল বাজেয়াপ্ত করে রাখে লোকটা৷ ফুটবল খেললে মাঝে মাঝে তো ওর বাড়িতে বল পড়বেই, বলেন, যদি মাঠের পাশেই বাড়ি বানিয়ে রাখে?

সবই সহ্য করে যাই আমরা৷ আমাদের পাড়ায় এই একটাই মাঠ৷ আর কোথায় যাবো বলেন?


কিন্তু একদিন আমাদের খেলায় দেখা দেয় বিশাল গোলযোগ৷ বড়লোকের ছেলে টাটা ভাই একদিন আমাদের ফুটবল খেলার মাঝখানেই এসে তিনটা তিনটা ছয়টা স্ট্যাম্প গাড়েন৷ সাথে একগাদা ভিনপাড়ার পোলাপান৷

"আমরা এখানে ক্রিকেট খেলতে চাই৷" টাটা ভাই মিষ্টি হেসে বলেন৷

আমরা মুখ গোমড়া করে বলি, "আমরা এইখানে ফুটবল খেলি তো!"

টাটা ভাই আরো মিষ্টি হাসেন৷ "পারলে খ্যালো, বাধা নাই!"

আমাদের তর্কের মধ্যে রহমান চাচা বেরিয়ে আসেন বাড়ি ছেড়ে৷ "বাবা টাটা! ক্যামন আছো বাপধন? দ্যাশে আসলা কবে?"

টাটা ভাই ব্যাট ফেলে কদমবুসি করেন৷ "চাচাজি! এই তো কয়েকদিন আগে৷"

রহমান চাচা খুঁটিয়ে স্ট্যাম্পগুলি দেখেন, তারপর ব্যাটগুলি দেখেন, তারপরে নিজের বাড়ির জানালার কাঁচগুলি দেখেন ভবিষ্যৎ ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করার জন্য৷ আর তখনই দ্যাখেন যে তার সুন্দরী মেয়ে পুতুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে গা মোচড়াচ্ছে আর টাটা ভাইয়ের দিকে কটাক্ষপাত করে যাচ্ছে৷ তিনি দুয়ে দুয়ে চার মিলান৷

"ক্রিকেট খেলবা বাবা টাটা?" মধুর গলায় বলেন তিনি৷

"ইচ্ছা তো ছিলো আঙ্কেল৷ কিন্তু .. ..৷" মলিন গলায় বলেন টাটা ভাই৷

"কিন্তু কিসের বাবা কিন্তু কিসের? বড় মানুষের বড় পোলা তুমি, তুমি এই মাঠে খেলবা এইটা তো আমার সৌভাগ্য৷ এই গুড়াগাড়া পোলাপান কোন ঝামেলা করলে আমারে বলবা, বাইরাইয়া এগুলির হাড্ডি ভাঙ্গুম!" রহমান চাচা কটমটিয়ে তাকিয়ে আমাদের ছাই করেন৷

টাটা ভাই দিলখোলা হাসেন৷ "আরে না না৷ ওরা তো এ পাড়ারই সন্তান৷ ওদের সাথেই ক্রিকেট খেলবো আমি৷ ওরা বল করবে, আমি ছক্কা মারবো৷ ওরা ব্যাট করবে, আমি এক বলে তিন স্ট্যাম্প গুঁড়া করবো৷ ওরা না থাকলে খেলে মজা কী বলেন?" টাটা ভাই সি্নগ্ধ হাসেন আমাদের দিকে চেয়ে৷

আমরা ঢোঁক গিলি৷

রহমান চাচা গ্যালগ্যাল করে হাসতে হাসতে একবার পুতুলের দিকে তাকিয়ে কী যেন বলতে যান, কিন্তু তার আগেই টাটা ভাই গম্ভীর হয়ে যান৷ "কিন্তু চাচা, আপনি যদি চান আমরা এখানে খেলি, বিশেষ করে আমি এখানে খেলি তা-ই যদি চান আপনি," একবার পুতুলের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে জিভ বার করে ঠোঁট চাটেন টাটা ভাই, "তাহলে আমাদের কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে৷ বুঝতেই পারছেন, আড়াই হাজার টাকার খেলাধূলার সরঞ্জাম এখানে এনে খেলবো, কিছু শর্ত তো আপনাকে মানতে হবে৷"

রহমান চাচা হাত কচলাতে কচলাতে বলেন, "কী শর্ত বলো বাবা বলো৷"

টাটা ভাই গলা খাঁকরে বলেন, "খেলতে খেলতে তো আমাদের পিপাসা লাগবে৷ পানি খেতে হবে৷ ঘাম বের হবে, হাতমুখ ধোয়া গোসলের জন্য পানি লাগবে৷ আরো বিশদিন দেশে আছি আমি, এই বিশদিন আমাকে মাঙনা পানি দিতে হবে৷"

রহমান সাহেব একটু কাঁচুমাচু হন৷ ওনার বাসায় পানি চাইলে উনি পানি দ্যান না, বলেন ওনার দোকান থেকে পেপসি কিনে খেতে৷ আমরা মাঝে মাঝে তা-ই করি, কী করবো, তেষ্টা৷

টাটা ভাই ভুরু নাচান৷ "কী চাচা, রাজি?"

রহমান চাচা বিগলিত হেসে বলেন, "রাজি না মানে? তোমাকে আমি গ্যালন গ্যালন পানি দিবো৷ নতুন একটা পুকুর কাটাচ্ছি ঐ পাশে, তোমাদের জন্যই তো৷ আর খাওয়ার পানির কথা ভাইবো না বাবা, ঐ যে আমার নারিকেল গাছ. তোমাদের ডাব পাইড়া খাওয়াবো৷ এই পোলাপানগুলি খুব ভালো যাব পাড়তে পারে, তুমি খালি কষ্ট কইরা আওয়াজ দিবা, ওরা পটাপট পাইড়া আনবে৷ আর যদি সব পানি শেষও হয়ে যায়, আমি পাশের বাড়ির মনার মার কাছ থেকে পানি কিনে এনে খাওয়াবো তোমাকে৷ তবু খ্যালো বাবা৷"

আমরা একবার হাঁকরে পুতুলের দিকে তাকাই, একবার তাকাই রহমান চাচার দিকে, তারপর তাকাই টাটা ভাইয়ের দিকে৷ টাটা ভাই হাসেন৷

আমাদের কলিজা শুকিয়ে আসে৷


ফেব্রুয়ারি ১০, ২০০৬

1 comment:

Sakib said...

হা হা হা
আমার কাছে আপনার এই লেখাটা জোস লাগছে...

আমি আপনার ভক্ত হয়ে গেলাম। তবে ''কাটুমাচু'' কথাটা পড়ে খুব হাসি পেয়েছে...

আমি আরো একটু হাসি... হা হা হা