Monday, September 04, 2006

রহস্যগল্প ০০২


রহস্যভেদী গাব্রিয়েল মগাদিশু চৌরাসিয়া গম্ভীর নিশ্চুপ মুখে বারান্দায় বসে। তাঁর পরনে একটি লাল রঙের গ্যাবার্ডিনের হাফপ্যান্ট, ফুটপাথের হকারের কাছ থেকে ষাট টাকা দামে কেনা, দামী ডিটারজেন্টে ধোয়া এবং ইস্ত্রি করা। লাল রংটা একটু যেন বিষণ্ন হয়ে পড়েছে আবহাওয়ার পরিবর্তনে।

চৌরাসিয়া গম্ভীর হয়ে আছেন অন্য কারণে। তাঁর নতুন কেনা হলুদ লুঙ্গিটা চুরি গিয়েছে। বারান্দায় শুকানোর জন্য সেটাকে টাঙ্গাইল করা হয়েছিলো, কে যেন সেটাকে সরাইল করে নিয়ে গেছে। কিন্তু রহস্যজনক ব্যাপার, আর কোন কিছু নড়াইল করে যায়নি। মগাদিশু চৌরাসিয়া প্রচুর ঘাটাইল করে দেখেছেন, কোন ক্লু খুঁজে পাননি। অত্যন্ত ঘাগু চোর। কিন্তু চোর ব্যাটা বা বেটি জানে না, যে প্রখ্যাত রহস্যভেদী গবেষক গাব্রিয়েল মগাদিশু চৌরাসিয়া এখন তাকে তাড়াইল করে বেড়াচ্ছেন। চোর (বা চুনি্ন)টিকে তাড়া করে বেড়াবার জন্য যে পদ্ধতিটি চৌরাসিয়া অবলম্বন করেছেন, সেটি অবশ্য অভিনব। তিনি তাঁর প্রকান্ড আতশ কাঁচটি বার করে গলিতে গলিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন না, বরং লাল হাফপ্যান্টটি পরে বারান্দায় বসে ভোগান্তির গেলাসে মৃদুমন্দ চুমুক দিচ্ছেন। রহস্যভেদী জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানেন, অপরাধীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অপকর্ম করার পর প্রথমে একচোট ভাগাইল হবার পর আবার ফিরে এসে আড়ালে আবডালে থেকে অকুস্থল পর্যবেক্ষণ করা। যতো রাজ্যের গেঁেড় বদমাশ তা-ই করে। আর তাঁর বারান্দায় টাঙ্গাইল হলুদ লুঙ্গিটিকে ওভাবে গাপ করার সাধ ও সাধ্য রাখে যে অপরাধী, সে যে অত্যন্ত জটিল ও কূটিল স্বভাবের, এবং সে-ও যে আড়ালে বসে চৌরাসিয়ার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে চাইবে, তা চৌরাসিয়া স্বতসিদ্ধ হিসেবে ধরে নিয়েছেন। তবে একই সাথে তিনি তাঁর নোটপ্যাডে নোট করছেন। সম্ভাব্য কে কে চুরি করতে পারে তাঁর সাধের পীতবর্ণের লুঙ্গিটিকে?

উলটোদিকের ফ্ল্যাটের মিসেস অর্ধকুমারীর কথা মনে আসে তাঁর। মহিলা বিদঘুটে সব জামা কাপড় পরেন। যদিও এখনও লুঙ্গি পরা ধরেননি, কিন্তু ধরতে বাধা কি? হয়তো মিসেস অর্ধকুমারী ক্লেপটোম্যানিয়াক, ঘরে চুরি করা লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়ান। কিছুই অসম্ভব নয়। ভাবতে ভাবতে আচমকা চৌরাসিয়া একেবারে সোজা হয়ে বসেন। উলটোদিকের ফ্ল্যাটের বারান্দায় বেরিয়ে এসেছেন মিসেস অর্ধকুমারী, মাথায় একটা হলুদ পট্টি বাঁধা!

চৌরাসিয়া ভাবেন, আমার লুঙ্গিটিকে ছিঁড়েই এই মাথার পট্টবস্ত্রটি তৈরি নয়তো? আমার সাধের সিল্কের লুঙ্গি! চৌরাসিয়ার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে, তিনি পাশে রাখা দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি তুলে নিয়ে মিসেস অর্ধকুমারীকে আগাপাস্তলা পর্যবেক্ষণ করেন। নাহ, মহিলাকে দূরবীণ লাগিয়ে দেখার মানেই হয় না, অত্যন্ত বিখাউজ ফিগার, তিনি হলুদ পট্টিতে মনোযোগ দেন। শক্তিশালী দূরবীণ দিয়ে খানিকক্ষণ দেখে তিনি টের পান, না, এটা তাঁর লুঙ্গিছেঁড়া কাপড় নয়। এটাতে সূক্ষ কালো স্ট্রাইপ আছে। দূরবীণ নামিয়ে আবার বিষণ্ন মনে তিনি ভোগান্তির বোতলে চুমুক দেন। হায়রে সমাজ! সামান্য একটা লুঙ্গিও আজ ছ্যাচ্চোরদের হাত থেকে নিরাপদ নয়। রাজশাহী সিল্কের একটা সামান্য লুঙ্গি, তা-ও তিনি নিরাপদে পড়তে পারেন না। চৌরাসিয়া মনে মনে ঠিক করেন, তিনি দেশ ছেড়ে সুইৎজারল্যান্ড চলে যাবেন, কোন একটা পাহাড়ি কুটিরে বসবাস করবেন, চমরী গাইয়ের উল দিয়ে বানানো লুঙ্গি পরে থাকবেন সেখানে।

তবে ভোগান্তির গেলাস কয়েকবার নিঃশেষ হবার পর চৌরাসিয়া আবারও বিকল্প ভাবনায় ডুবে যান। সুইৎজারল্যান্ডেও যে লুঙ্গিতস্কর (বা তস্করনী) নেই তার নিশ্চয়তা কে দেবে? নাকি লুঙ্গি পরাই ছেড়ে দেবেন তিনি, পাড়ার উদাস পাগলটার মতো নির্লিপ্ত দিগম্বর হয়ে ঘুরে বেড়াবেন? অবশ্য পাগলটার যা যতটুকু আছে তা ততটুকু তাঁর নেই, তাছাড়া ন্যাংটো হয়ে ঘুরে বেড়ানোর অনেক হ্যাপা, সিটি করপোরেশন এসে তুলে নিয়ে যেতে পারে। নাকি ইয়োরোপের কোন দেশে প্রকৃতিবাদী কোন ক্লাবে গিয়ে নাম লেখাবেন? ভাবতে ভাবতে তাঁর মেজাজটা আবারও বিগড়ে যায়।

একটা কাশির শব্দ পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে ডানে তাকিয়ে তিনি দেখেন, পাশের ফ্ল্যাটের সিনে সাংবাদিক পমি রহমান একটা ভাস্কোদাগামা গোছের দূরবীণ লাগিয়ে কী যেন দেখছে। দূরবীণের নল অনুসরণ করে তিনি নিজের দূরবীণ তাক করেন, দেখেন মিসেস অর্ধকুমারী বারান্দায় স্কিপিং করছেন। রোগা হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা। তবে আনুষঙ্গিক আন্দোলন হচ্ছে বেশ, পমি রহমান বোধহয় তা-ই দেখছে। সিনেমাখোরদের এমনই হয়। কিছুতেই মোটা মহিলাদের লাফঝাঁপ না দেখে থাকতে পারে না। চৌরাসিয়া দূরগত যৌবনে কিছুদিন এফডিসিতে কাল্লু ওস্তাদের সাগরেদি করেছেন, সিনে সাংবাদিকদের তিনি রগে রগে চেনেন। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক শোভন মনে হয় না তাঁর কাছে। তিনি রহস্যভেদী, তাছাড়া এখন ভিকটিম, দূরবীণ তাঁর হাতে বিলক্ষণ মানায়। কিন্তু পিপিং টম পমি রহমান সেটা চোখে লাগিয়ে মহল্লা চষে বেড়াবে, সেটা ভালো লাগে না চৌরাসিয়ার কাছে। তিনি ঘোঁৎকার করে জিজ্ঞেস করেন, "ব্যাপার কি পমি সাহেব, পাখি দেখেন নাকি?"

পমি রহমান অত্যন্ত ঘাগু চীজ, সেও ঘোঁৎ করে বলে, "পাখি নয়, পশু দেখি। কাঙারু। বেজায় লাফাচ্ছে। না জানি কখন পেটিকোট ছেড়ে বেরিয়ে আসে!"

চৌরাসিয়া ভোগান্তির গেলাসে চুমুক দেন। "কাঙারু পেটিকোট পরে নাকি?"

পমি রহমান দাঁতে দাঁত পিষে বলে, "শুধু যে পেটিকোট পরে, তা-ই নয়, আমার ব্যাঙ্কক থেকে কেনা লাল গেঞ্জিটার মতো দেখতে একটা ব্লাউজও পরে!"

চৌরাসিয়া চমকে ওঠেন। "মানে?"

পমি রহমান দাঁত খিঁিচয়ে বলে, "আরে ভাই আর বলবেন না। গেলোবার ব্যাঙ্কক গেলাম, চাকভূম চাকভূম ছবির শু্যটিং কাভার করতে, ফেরার পথে একটা দামী সিল্কের লাল গেঞ্জি কিনেছিলাম, কে বা কাহারা গতকাল সেটা বারান্দা থেকে ঝেড়ে দিয়েছে। তাই তো দূরবীণ দিয়ে তদারক করছি। কাউকে লাল গেঞ্জি পরে বেরোতে দেখলেই গিয়ে ধরে ঠ্যাঙাবো।"

চৌরাসিয়া বলেন, "হুম! পাড়ার লোককেই কেন সন্দেহ করছেন আপনি?"

পমি রহমান দাঁত খিঁচিয়ে বলে, "আরে, এই পাড়াটাই যতো ধান্দাবাজ লোকে ভরা! তাছাড়া পেশাদার চোরের কাজ না, যে চুরি করেছে সে ঘাগু চোর! কোন ক্লু-ই ফেলে যায়নি!"

চৌরাসিয়া বিষণ্ন হয়ে পড়েন আবারও। পমি রহমানের মতো সিনে সাংবাদিকও আজকাল রহস্যভেদের মতো শক্ত কাজ অম্লানবদনে করে ফেলছে। কোন প্রফেশন্যাল কার্টেসি নেই। তিনি তো কখনো নায়িকা চন্দ্রিমার শরীরের মাপ নিয়ে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখতে যান না। পমি রহমানেরও কি উচিত ছিলো না এমন একটা রহস্য নিয়ে তাঁর শরণাপণ্ন হওয়া? চৌরাসিয়া আবার বিবেচনা করতে থাকেন, স্পেনের কোন রমরমা প্রকৃতিবাদী ক্লাবে নাম লিখিয়ে বিবস্ত্র হয়ে সৈকতে পড়ে থাকবেন কি না। লুঙ্গি গেঞ্জি হারিয়ে এভাবে আর কাঁহাতক?

পমি রহমান হতাশ হয়ে চোখ থেকে দূরবীণ নামিয়ে বলে, "নাহ, এটা আমার গেঞ্জির কাপড় না, ভেতরে ব্রা দেখা যাচ্ছে না। আমার গেঞ্জি একেবারে ফিনফিনে পাতলা।"

চৌরাসিয়া বিমর্ষতর হয়ে পড়েন। পমি রহমানের ডিডাকশন খুব একটা খারাপ নয়। কি গেরো! স্পেনে এক বন্ধু থাকে তাঁর, ঐ ব্যাটাকে আজই ইমেইল করতে হবে।

হঠাৎ একটা বেসুরো গানের শব্দ এসে তাঁর কানে ধাক্কা মারে। কে যেন চেঁচিয়ে গাইছে, মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই, দিন দুখিনী মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই ...। কী জঘন্য গলা! সুরের প্রতি সামান্য দরদ আছে এমন যে কেউ নিজের গানের এমন দশা শুনলে চুপ করে যেতো, কিন্তু এই ব্যাটা মনে হচ্ছে অবিমিশ্র ঠসা! আওয়াজটা আসছে মিসেস অর্ধকুমারীর ওপরের ফ্ল্যাট থেকে। চৌরাসিয়া নিজের রহস্যভেদী মনকে সক্রিয় করে তোলেন। গমগমে আওয়াজটা শুনে মনে হচ্ছে কেউ ছোটঘরে গিয়ে এই অপকর্মটি করছে। অনেকেই আছে না গাইলে হেগে উঠতে পারে না। কেউ গোসল করতে করতে গান গায়। এই দুষ্কৃতীটিও মনে হচ্ছে এই দুটি কাজের একটির সাথে সম্পৃক্ত।

আরো মিনিট দশেক এই গান চলে। চৌরাসিয়া ভাবতে থাকেন, টয়লেটে গিয়ে লোকে গান গায় কেন? এর মাজেজা কী? কিন্তু আরো মিনিট পাঁচেক পর গায়ক যখন গান গাইতে গাইতে বারান্দায় বেরিয়ে আসে, চৌরাসিয়া চমকে প্রায় চেয়ার থেকে পড়ে যান। লোকটাকে তিনি হাড়ে হাড়ে চেনেন। সেই কার্বন মাঝি! পরনে লাল রঙের ফিনফিনে গেঞ্জি, বাহারী হলুদ রঙের লুঙ্গি। কাঁধে একটা সবুজ গামছা। মুখে গান ... মোরা এমনি পাষাণ তাই ফেলে ঐ পড়ের দোরে ভিক্ষে চাই ...!

এবার বাঁ দিক থেকে একটা অস্ফূট আওয়াজ আসে। চৌরাসিয়া ঘাড় ফিরিয়ে দেখেন, বাঁয়ের ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতিবেশিনী মিস মঞ্জুময়ূরী। চোখে একখানা দূরবীণ। মঞ্জুময়ূরী দূরবীণ নামিয়ে একটা কিছু বলতে যান, চৌরাসিয়া হাতের ইঙ্গিতে তাঁকে থামিয়ে দ্যান।

"বলতে হবে না, বুঝেছি!" বিরস গলায় বলেন তিনি। "আপনার একটা সবুজ সিল্কের গামছা চুরি গেছে!"


-------------------
২৯ জুন, ২০০৬


2 comments:

I said...

আপনার ব্লগ ফায়ার ফক্সে ঠিকভাবে দেখা যায় না ।

মুখফোড় said...

হুমমম ... তাই তো দেখছি। মারুন ভাই ফায়ারফক্সকে কষে একটা থাবড়া।